ম্যাক্রোঁর ঘোষণা: যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনের পাশে সামরিকভাবে থাকবে ২৬ দেশ

ফ্রান্সের এলিসি প্রাসাদে ভিডিও সম্মেলন পরিচালনা করছেন প্রেসিডেন্ট এম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ছবি: লুডোভিক মারিন/রয়টার্স
প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানালেন, যুদ্ধ-পরবর্তী ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ছাব্বিশটি দেশ একত্রে অঙ্গীকার করেছে। ভূমি, সমুদ্র ও আকাশপথে একটি আন্তর্জাতিক “নিশ্চয়তা বাহিনী” গঠনের বিষয়েও মত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়ে ম্যাক্রোঁ বললেন, “যেদিন এই সংঘাত শেষ হবে, সেদিনই এই নিরাপত্তা গ্যারান্টি কার্যকর হবে।”
ম্যাক্রোঁ আরও জানান, এই ছাব্বিশটি দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দিতে, যদিও সব দেশের নাম তিনি উল্লেখ করেননি। এই বাহিনী মূলত ইউক্রেনে নতুন করে কোনো বড় ধরনের হামলা ঠেকাতে কাজ করবে, সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামবে না। কেউ কেউ ইউক্রেনের বাইরে থেকে কাজ করবে—অর্থাৎ কিয়েভের সেনাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র-সরবরাহ করবে।
জেলেনস্কি এই পদক্ষেপকে ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তব পদক্ষেপ’ বলে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর মতে, অনেক দিন পর ইউক্রেনের পক্ষে এমন দৃশ্যমান সমর্থন দেখা গেল।
ম্যাক্রোঁ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই নিরাপত্তা গ্যারান্টিতে কীভাবে অংশ নেবে, তা কয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। তবে এই অবস্থানে রাশিয়া তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “এই ধরণের নিরাপত্তা গ্যারান্টি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।”
এই নিরাপত্তা গ্যারান্টি চূড়ান্ত করতে ইউরোপীয় নেতারা ৩৫ দেশের এক জোট গঠন করে, যার মধ্যে অধিকাংশই ইউরোপের। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আদায়ের চেষ্টা করেছে, কারণ ইউরোপ মনে করে, এই গ্যারান্টি কার্যকর করতে আমেরিকার সম্পূর্ণ সহায়তা অপরিহার্য।
তবে জার্মানি, স্পেন এবং ইতালি এখনও পর্যন্ত সৈন্য পাঠাতে রাজি হয়নি। জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, “আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ, অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার দিকে।” মূলত এই নীতিই ইউরোপ এখন অনুসরণ করছে।
ইউরোপীয় নেতারা সম্প্রতি ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে গিয়ে দেখা করেন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে। কারণ গত আগস্টে আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে এক গোপন বৈঠকের পর ইউরোপ শঙ্কিত হয় যে, ট্রাম্প হয়তো জেলেনস্কিকে একতরফাভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেন—যার মধ্যে ভূখণ্ড হারানোও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
তবে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি রুশ প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার অনুমতি আদায় করেছেন। কিন্তু রাশিয়া এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে এবং আগের মতোই ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছাড়ার ও ন্যাটোতে না যাওয়ার শর্তে অনড় রয়েছে।
ট্রাম্প অবশ্য পুতিনের প্রতি হতাশা প্রকাশ করেছেন। ডানপন্থী সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি কলার-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, এটি একেবারেই অর্থহীন যুদ্ধ।”
ইউরোপ মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে ট্রাম্প যেন এই যুদ্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন না হয়ে পড়েন। তবে তারা এখনো পর্যন্ত ট্রাম্পকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে, যে তিনি তার অসন্তোষকে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপে পরিণত করুন।
সম্মেলনে ম্যাক্রোঁ বোঝাতে চেয়েছেন যে ইউরোপ, রাশিয়ার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিছিয়ে যায় না। তিনি বলেন, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা গোপনে যে পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, তা এখন রাজনৈতিকভাবে অনুমোদনের জন্য প্রস্তুত।”
এদিকে, আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে প্যারিসে যোগ দিয়েছিলেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে আলাদা করে বৈঠকও করেন।
ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং ইউরোপ-আমেরিকার ভূরাজনৈতিক অঙ্গীকার—সবকিছুই এখন একটি নড়বড়ে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়ার হুমকি, ইউরোপের দোটানা আর আমেরিকার অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে জটিল এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবুও জেলেনস্কি ও ম্যাক্রোঁর পাশে দাঁড়িয়ে এককথায় বলা যায়, যুদ্ধ থামলে যেন আর নতুন যুদ্ধ শুরু না হয়—এমন ব্যবস্থা গড়তে প্রস্তুত বিশ্বের অন্তত ছাব্বিশটি দেশ।