Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়

বিজয় দিবসে চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ বিশ্বকে কী বার্তা দিলো

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৪ এএম

বিজয় দিবসে চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ বিশ্বকে কী বার্তা দিলো

বিজয় দিবসে চীনের সামরিক কুচকাওয়াজ। ছবি: সংগৃহীত

জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা জনগণের প্রতিরোধ এবং বিশ্ব ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ আমরা বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছি। এই কুচকাওয়াজ তৎকালীন দুর্বিষহ এবং ঐতিহাসিক বিজয়কে স্মরণ করে আয়োজিত হয়। এটি শুধু সেই আগুনঝরা ও রক্তপাতের বছরগুলির দিকে ফিরে তাকানোর জন্যই নয়, বরং নতুন যুগের সমন্বয়ে বিশ্বের কাছে এই বার্তা দেওয়া— এটি শান্তির জন্য পূর্বাঞ্চলের শপথ এবং মানবতার জন্য অংশীদারত্বের ভবিষ্যত সম্প্রদায় গড়ে তোলার গভীর প্রতিশ্রুতিও। 

‘ইতিহাসকে মনে রাখা, শহীদদর সম্মান করা, শান্তি ধারণ করা এবং উন্নত ভবিষ্যতের জন্য প্রচেষ্টা’—এই শব্দগুলি এই জাতীয় স্মরণ অনুষ্ঠানের মহৎ উদ্দেশ্য এবং গভীর তাৎপর্যকে তুলে ধরে। দৃঢ় এই সামরিক কুচকাওয়াজ চীনের ১ দশমিক ৪ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতীক এবং বিশ্বজুড়ে সমস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষের পরস্পরের প্রত্যাশাকে ঐক্যবদ্ধ করে। 

ইতিহাসকে মনে রাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে চীনের অর্জনকে সামনে তুলে ধরে এবং যুদ্ধের উপর সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হিসেবে কাজ করে। কিছুকাল ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করার সময় এমনভাবে করা হয় সেট ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা না হোক, কিন্তু তা পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রে চীনের বিশাল অবদানকে অবমূল্যায়ন বা উপেক্ষা করে। যদিও ইতিহাসের সত্য কখনো মুছে ফেলা যায় না। 

ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সেই বিশ্ব যুদ্ধে চীনের প্রতিরোধ সবার আগে শুরু হয়েছিল এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল। ১৪ বছরের রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি স্বদেশী নিহত হয়েছিল। আর ১ দশমিক ৫ মিলিয়নেরও বেশি জাপানি সৈন্য নিহত হয়েছিল। জাপানের প্রধান বাহিনীকে পরাজিত করেছিল চীন। আর এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে এবং দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হওয়ার তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। চীনের এই ভূমিকাই বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জোটের বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

আমরা এই ঘোষণা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছাতে বিজয় দিবসের স্মরণসভা পালন করি যে চীনা যুদ্ধক্ষেত্র ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বিশ্ব যুদ্ধের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। আর চীনা জনগণ সেই চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য ব্যাপক ও অনস্বীকার্য ত্যাগ স্বীকার করেছে। এই স্মরণ ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং সর্বজনীন মানবিক নীতিগুলির পুনর্নিশ্চয়তা। এই ইতিহাসকে অবমূল্যায়ন করা মানব বিবেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং এটিকে বিকৃত করা বিশ্ব শান্তির ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়।

শহীদদের সম্মান জানানো মানে প্রতিরোধের মহান চেতনা এবং আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শক্তির অক্ষয় উৎসের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমরা যা স্মরণ করি তা কেবল বিজয়ের দিন নয়, বরং সেই অগণিত অদম্য মহৎ হৃদয়ের মানুষদের—যারা এই উপলক্ষে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। উত্তর-পূর্বের তুষারাবৃত পাহাড় এবং কালো জলরাশি থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের তীর পর্যন্ত, গ্রেট ওয়ালের পাদদেশ থেকে চীনের বিস্তৃত নৌ ও স্থলভূমি পর্যন্ত অসংখ্য বীর জীবন দিয়ে আমাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় একটি নতুন গ্রেট ওয়াল তৈরি করেছেন। 

ইতিহাসে তাদের কিছু নাম অমর হয়ে আছে। যদিও আরও অনেক নাম অজানা। তবুও তারা একসঙ্গে প্রতিরোধের মহান চেতনা জাগিয়ে তুলেছিল: একটি দেশপ্রেমিক বিশ্বাস যে ‘প্রত্যেকেরই তার দেশের প্রতি কর্তব্য আছে। এটি এমন এক জাতীয় চেতন যা ‘আত্মসমর্পণের চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়’, ‘সহিংসতার ভয় ছাড়াই শেষ পর্যন্ত লড়ে যায়’।  এটি এমন এক বীরত্বপূর্ণ সংকল্প এবং ‘অদম্য মনোভাব’ যা চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতি অটল বিশ্বাস ধারণ করে। 

আজ যখন আমরা শহীদদের এই সম্মান জানাই তখন আমাদের অবশ্যই এই চেতনাকে আমাদের রক্তে আরও গভীরে জায়গা দিতে হবে। এই আধ্যাত্মিক শক্তিই আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে যে আমরা কখনও কষ্ট এবং বাধার মুখে পরাজিত বা পরাজিত হব না। আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের ভূমির শান্তি এবং আমাদের জাতির স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে; তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে তারা যে চেতনার মশাল জ্বেলে গেছেন তা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

শান্তিকে লালন মানে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে শৃঙ্খলাকে দৃঢ়ভাবে সমুন্নত রাখা এবং মানবজাতির জন্য ন্যায়বিচারকে চ্যালেঞ্জ করে এমন যেকোনো কাজকে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করা। চীনা জনগণ যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা গভীরভাবে বোঝে এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের আশীর্বাদকে আন্তরিকভাবে ধারণ করে। আমরা এমন এক জাতি যারা সর্বোপরি শান্তিকে মূল্যবান বলে মনে করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় জাতিসংঘের মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্ম দেয়। আর জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতির উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় মৌলিক নিয়মকানুন তৈরি করে। এটি মানবতার বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত অমূল্য এক উত্তরাধিকার।

চীন কেবল এই ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের একজনই নয়, বরং এর অবিচল রক্ষক ও নির্মাতাও। তবে আজকের বিশ্ব শান্তিপূর্ণ নয়; আগ্রাসনের ইতিহাস অস্বীকার করার ভূত এখনও রয়ে গেছে এবং সামরিকবাদ পুনরুজ্জীবিত করার প্রহসন প্রায়শই দেখা যাচ্ছে। এই পটভূমিতে শান্তি রক্ষার জন্য আমাদের দৃঢ় সংকল্প ও সক্ষমতা প্রদর্শন—ইতিহাসকে ফেরানোর এবং যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের চেষ্টাকারী সমস্ত শক্তির জন্য একটি সতর্কতা হিসেবে কাজ করে। চীনা জনগণ কখনই আগ্রাসনের মতো কোনো কাজ বা ঐতিহাসিক ঐকমত্যকে চ্যালেঞ্জের কোনো প্রচেষ্টাকে মেনে নেবে না। চীনের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন স্বার্থের ক্ষতি করে এমন কোনো পরিকল্পনার মুখে চীনা জনগণ কখনও চুপ থাকবে না!

উন্নত ভবিষ্যতের চেষ্টা এবং মানবতার জন্য অংশীদারত্বমূলক ভবিষ্যৎ সম্প্রদায় নির্মাণকে উৎসাহিত করতে চীন সর্বদা সচেষ্ট। ইতিহাস স্মরণ মানে শেষ পর্যন্ত সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রচেষ্টা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গভীর শিক্ষা আমাদের বলে দেয়, মানবতার ভাগ্য পরস্পর সংযুক্ত এবং ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কুসংস্কার, ঘৃণা, শত্রুতা এবং সংঘাত কেবল নতুন যুদ্ধ এবং বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমতা এবং সব পক্ষ জয়ী—এমন সহযোগিতাই এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ। মানবতার জন্য অংশীদারত্বের ভবিষ্যৎ সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য চীনের প্রস্তাব এবং তার চারটি বৈশ্বিক উদ্যোগ এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং সময়ের প্রতিক্রিয়ার গভীর সারসংক্ষেপ। আমরা যা অনুসরণ করি তা ‘শক্তিশালী সব দেশ আধিপত্য খুঁজবে’ এই পুরোনো যুক্তি নয়, বা এটি একটি শূন্য-সমষ্টির খেলাও নয়—যেখানে ‘বিজয়ী সবকিছু নিয়ে যায়’। বরং স্থায়ী শান্তি, সর্বজনীন নিরাপত্তা এবং সম্মিলিত সমৃদ্ধির একটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিষ্কার এবং সুন্দর পৃথিবী।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যখন ‘স্বেচ্ছাসেবকদের মার্চ’ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এবং কুচকাওয়াজ চাং’আন অ্যাভিনিউ বরাবর মার্চ করছে, তখন জাতীয় প্রতিরক্ষার আধুনিক সরঞ্জামের বিশাল প্রদর্শন নিঃসন্দেহে শান্তি রক্ষার জন্য চীনা জনগণের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং ক্ষমতাকে তুলে ধরে। এই সামরিক কুচকাওয়াজ চীনা জাতির চেতনা ও প্রাণশক্তির এক গভীর পর্যালোচনা, শান্তির রক্ষক হিসেবে চীনা সৈন্যদের দৃঢ় ঘোষণা এবং মানবতার জন্য অংশীদারত্বমূলক ভবিষ্যৎ সম্প্রদায় গঠনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে চীনা জনগণের প্রতিশ্রুতির এক বিবৃতি।

বিজয় দিবসের নামে আমরা শহীদদের সম্মান জানাই। পাশাপাশি কষ্টার্জিত শান্তি রক্ষা এবং উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি। 

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন