Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

তিয়ানজিনে শি-মোদি বৈঠক: ড্রাগন ও হাতির বন্ধুত্বে নতুন অধ্যায়

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:০৮ এএম

তিয়ানজিনে শি-মোদি বৈঠক: ড্রাগন ও হাতির বন্ধুত্বে নতুন অধ্যায়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ৩১ আগস্ট ২০২৫, তিয়ানজিনে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে আলাপচারিতার আগে করমর্দন করছেন। ছবি: ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো/রয়টার্স

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে বললেন, বন্ধুত্বই দুই দেশের জন্য সঠিক পথ। সাত বছর পর একে অপরের মুখোমুখি হলেন তাঁরা, সেই সঙ্গে এই প্রথমবার চীনে একসঙ্গে বৈঠকে বসলেন দুই নেতা। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুই দেশ, যারা এখন একে অন্যের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে, আর এই ঘনিষ্ঠতার পেছনে বড় একটা কারণ আমেরিকার সঙ্গে তাদের টানাপোড়েন। এই বৈঠক হয়েছিল তিয়ানজিন শহরে, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে।

দুই নেতার মুখোমুখি এই সাক্ষাৎ ছিল অনেক আগ্রহ আর কৌতূহলের কেন্দ্রে। শি বললেন, “আজকের বিশ্ব এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জটিল এবং অস্থির।” মোদির দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বললেন, “আমাদের উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ, ভালো প্রতিবেশী হওয়া; এমন সহযোগী হওয়া যারা একে অন্যকে সাফল্য পেতে সাহায্য করে। ড্রাগন আর হাতি একসাথে নাচতে পারে, যদি তারা প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হতে চায়।”

মোদি বললেন, ভারত চায় সম্পর্ক এগিয়ে যাক, বিশ্বাস আর সম্মানের ভিত্তিতে। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, সীমান্তে উত্তেজনা কমেছে, বিশেষ করে ২০২০ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর, যেখানে দু’দেশের সেনারা প্রাণ হারিয়েছিল হিমালয়ের বরফ ঢাকা সীমান্তে। মোদি বললেন, “আমাদের দুই দেশের দুইশো আশি কোটি মানুষের ভাগ্য আমাদের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে।”

এই বন্ধুত্বের বার্তা শুধু দুই দেশের জন্য নয়, ওয়াশিংটনও তা খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখছে। ট্রাম্পের আমলে আমেরিকা আর ভারতের মধ্যে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, তা এখন কিছুটা টালমাটাল। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর কঠিন শুল্ক বসিয়েছে — আগে ২৫ শতাংশ, পরে আরও ২৫ শতাংশ যুক্ত হয়েছে। চীনও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল নেয়, কিন্তু আমেরিকা এখনও তাদের বিরুদ্ধে সে অর্থে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি।

মোদি বললেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন আগের দিন, যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত আগেও বলেছে, তারা কোনো পক্ষ নেয় না। জেলেনস্কিও তাঁর ভাষণে বললেন, তুরস্ক, আজারবাইজান আর কাজাখস্তানসহ প্রায় সবাই যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে — এরা সবাই চীনের এই সম্মেলনে এসেছেন।

মোদি সোমবার পুতিনের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করবেন, যেখানে সম্ভবত ভারত-রাশিয়ার তেলের বিষয়টি উঠবে। এই এসসিও সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, বেলারুশ, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ আরও বহু দেশ। চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিশটির বেশি দেশের নেতা যোগ দিচ্ছেন এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক আলোচনা ঘিরে।

সম্মেলনের আগে রবিবার রাতে শি জিনপিং একটি ভোজ সভার আয়োজন করেন। সেখানে তাঁর উষ্ণ আচরণ ও পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। রাশিয়ার প্রচারমাধ্যমের ভিডিওতে দেখা যায়, শি ও পুতিন হাসিমুখে কথা বলছেন, হাতের ভঙ্গিতে ভাব বিনিময় করছেন, একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। এই চিত্র এক সাধারণ চীনা নেতার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিগত, অনেক বেশি সম্পর্কনির্ভর।

এসসিও সম্মেলন চলাকালীন এই বৈঠকই ছিল শি ও পুতিনের প্রথম দেখা, ট্রাম্প-পুতিনের আলাস্কা বৈঠকের পর। ক্রেমলিনের এক উপদেষ্টা জানালেন, তাঁরা আলোচনা করেছেন রাশিয়া-আমেরিকার সাম্প্রতিক যোগাযোগ নিয়ে। পশ্চিমা দেশগুলো পুতিনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে যুদ্ধ থামানোর জন্য, আর এই আলোচনাগুলো যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

চীন চাইছে, আমেরিকা-ভারতের টানাপোড়েনের সুযোগে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করুক। কোয়াডের মতো জোট — ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সামরিক সহযোগিতা যেভাবে গড়ে উঠছে, তা চীনকে চিন্তায় ফেলেছে। সেই কারণে শি জোর দিচ্ছেন উন্নয়ন আর পরস্পরকে সাহায্যের ওপর। তিনি বললেন, দুই দেশই নবজাগরণের সন্ধিক্ষণে, আর তাই উন্নয়নই হতে পারে সবচেয়ে বড় মিলনের জায়গা।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিকস সম্মেলনে শি ও মোদি দেখা করেছিলেন। তারপর থেকেই সম্পর্ক একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। কোভিডের পর ফের চালু হয়েছে ভারত-চীন সরাসরি বিমান, তীর্থযাত্রীদের জন্য খোলা হয়েছে তিব্বতের পুরনো পথ, আবার দেওয়া হচ্ছে ভিসা।

এ মাসেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারতে এসে দশটি বিষয়ে মতৈক্য গড়ে তোলার কথা জানান, যাতে সীমান্তের উত্তেজনা না বাড়ে। এই বৈঠকে দুই দেশ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কী ঘটছে, তা নিয়েও আলোচনা করেছে বলে জানান ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিস্রি। তিনি বলেন, “তারা বোঝার চেষ্টা করেছে কীভাবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা যায়, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।”

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু চেষ্টার পরেও শি ও মোদির মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত আস্থা তৈরি হয়নি। ২০২০ সালের হিমালয় সংঘর্ষ সেই সম্পর্ককে অনেকটাই ভেঙে দেয়। সেই সময় ২০ জন ভারতীয় ও ৪ জন চীনা সেনা প্রাণ হারায়। এখনো দুই দেশ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সেনা মোতায়েন রেখেছে — ২,১০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত, যার সীমা আজও স্পষ্ট নয়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে।

তবু রবিবার দুই নেতা যেন একটা নতুন বার্তা দিতে চাইলেন। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা বিশ্বাস করেন মতপার্থক্য যেন বিরোধে না পরিণত হয়। তাঁদের মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক আর সহযোগিতাই দুই দেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি, সেই সঙ্গে একটি বহু-মেরু বিশ্বব্যবস্থা গড়তেও সাহায্য করবে। সূত্র: সিএনএন

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন