ট্রাম্পের উদ্যোগে জেলেনস্কি-পুতিন বৈঠকের প্রস্তুতি

ভ্লাদিমির পুতিন আর ভলোদিমির জেলেনস্কি মুখোমুখি শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন বলে জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইউরোপীয় নেতারা। তবে মস্কো এখনো এ খবর নিশ্চিত করেনি। একে অনেকেই সম্ভাব্য এক বড় অগ্রগতি বলছেন।
হোয়াইট হাউসে এক টানটান কূটনৈতিক দিনে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন, তিনি কোনো যুদ্ধবিরতি চান না। অন্যদিকে জেলেনস্কি আর তাঁর মিত্ররা চাইছিলেন দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। জেলেনস্কি বলেন, আলোচনার পর ১০ দিনের ভেতর কিয়েভের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে।
ট্রাম্প লিখলেন তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে, বৈঠকের শেষে তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করেছেন আর তাঁদের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের ব্যবস্থা শুরু করেছেন, স্থান পরে ঠিক হবে। তিনি জানান, পরে এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হবে, যেখানে থাকবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার আর জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেরৎসও বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মেরৎস সাংবাদিকদের বলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন আর রাজি হয়েছেন যে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে বৈঠক হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। তবে তিনি সতর্ক করে দেন, এখনো নিশ্চিত নয় পুতিন সাহস করে সেই শীর্ষ সম্মেলনে হাজির হবেন কি না।
রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে, ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে পুতিন বলেছিলেন তিনি সরাসরি আলোচনার ধারণার প্রতি উন্মুক্ত। কিন্তু বৈঠক আসলেই হবে কি না সে নিশ্চয়তা নেই। এরই মধ্যে জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেন যেকোনো ফরম্যাটে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, ভূখণ্ড-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে আলোচনা হবে।
এর আগে ট্রাম্প আলাস্কার অ্যানকোরেজে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে বলেন, এখন জেলেনস্কির দায়িত্ব হলো ছাড় দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া, যাতে যুদ্ধ থেমে যায়। সমালোচকরা এটিকে ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বলছেন, কারণ অনেকে মনে করেন ট্রাম্প পুতিনের কথায় প্রভাবিত হয়ে তাঁর ভাষা অনুকরণ করতে শুরু করেছেন।
গত সপ্তাহেই ট্রাম্প রাশিয়াকে হুঁশিয়ার করেছিলেন, যদি যুদ্ধ না থামে তবে ভয়ঙ্কর পরিণতি আসবে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের বৈঠকে তিনি সুর পাল্টে বললেন যুদ্ধবিরতির দরকার নেই, বরং আমেরিকা ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাহায্য করবে। তবে তিনি যোগ করলেন, ইউরোপকেই এই দায়িত্বের বড় অংশ নিতে হবে।
জেলেনস্কি জানালেন, তাঁর দেশ ৯০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন অস্ত্র কেনার প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে আছে যুদ্ধবিমান আর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তিনি বলেন, এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়েছে, ভবিষ্যতে আমেরিকা ইউক্রেনের ড্রোন কিনবে।
ট্রাম্প ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বললেন, নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, আর কোন কোন নিশ্চয়তা ইউরোপীয় দেশগুলো দেবে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে ঠিক হবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ স্পষ্ট করে দিলেন, আলোচনায় ইউক্রেনের কোনো ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার বিষয় নেই।
প্রথমবারের মতো নয়, ছয় মাস আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ওভাল অফিসে জেলেনস্কির দেখা হয়েছিল। তখন ট্রাম্প আর তাঁর সহ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স তাঁকে প্রকাশ্যে বিব্রত করেছিলেন। এবার দৃশ্যটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জেলেনস্কি কৃতজ্ঞতা জানালেন আর ট্রাম্পের সঙ্গে হাস্যরসও ভাগ করে নিলেন।
তবে ইউরোপীয় নেতাদের অনেকে যুদ্ধবিরতি ছাড়া শান্তি আলোচনার বিষয়টি মেনে নিতে নারাজ। জার্মান চ্যান্সেলর মেরৎস বললেন, আলোচনার বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য অন্তত যুদ্ধবিরতি অপরিহার্য। মাখোঁও বললেন, একটি অন্তর্বর্তী বিরতি এখন জরুরি। কিন্তু ট্রাম্প দৃঢ় থাকলেন তাঁর অবস্থানে, জানালেন যুদ্ধবিরতির বিষয়টি দুই প্রেসিডেন্টের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এদিকে ইউক্রেন জানাল, রাশিয়ার হামলায় সোমবার অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ছিল একটি ছোট শিশু আর তাঁর কিশোর ভাই।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বললেন, প্রথম আলোচনার বিষয় অবশ্যই হবে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, যাতে ভবিষ্যতে এ যুদ্ধ আর না ঘটে। মাখোঁ যোগ করলেন, ইউক্রেনের ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিশ্চিত করাই মূল বিষয়।
প্রশ্ন করা হলে ট্রাম্প জানান, কোনো সমঝোতা না হলেও আমেরিকার সমর্থন থেমে যাবে না। তবে তিনি চান, একবার শান্তি হলে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হোক।
জেলেনস্কি বলেন, তাঁর দেশের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে জরুরি শক্তিশালী সেনাবাহিনী, অস্ত্র কেনা আর প্রশিক্ষণ। আরেক অংশ নির্ভর করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো আর আমেরিকা কতটা নিশ্চয়তা দেয় তার ওপর।
শেষদিকে কিছুটা হালকা পরিবেশও তৈরি হয়। এক সাংবাদিক জেলেনস্কির পোশাক নিয়ে মজা করলে ট্রাম্প হাসিমুখে তাতে সায় দেন, জেলেনস্কিও রসিকতা ফেরত দেন। আগের বৈঠকের তিক্ততা যেন মিলিয়ে যায় সেদিন।