আল জাজিরার বিশ্লেষণ
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক তলানিতে, ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের আঘাত

মেঘা বাহরি
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৬ এএম

যখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে — যা এখন পর্যন্ত যেকোনো দেশের ওপর আরোপিত সর্বোচ্চ হারে পৌঁছেছে — তখন এটা স্পষ্ট যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার না দিয়ে নিজ দেশে উৎপাদনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করে, যা রাশিয়া থেকে তেল আমদানির কারণে দেওয়া হয়েছে। ফলে মোট শুল্কের হার দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। এটা অনেককে বিস্মিত করে দেয়, কারণ নয়াদিল্লি ছিল প্রথম দেশগুলোর মধ্যে যারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছিল। তাছাড়া ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে অপরকে প্রকাশ্যে বারবার বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন। এই মুহূর্তে ব্রাজিল ছাড়া আর কোনো দেশের ওপর এত উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়নি।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন অব কানাডার স্ট্র্যাটেজি ও রিসার্চের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভিনা নাজিবুল্লাহ বলেন, "বাণিজ্য আলোচনার ভেঙে পড়া বিস্ময়কর ছিল। এটা একটি খুব কঠিন সময়, সম্ভবত বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময়। ভারত এখন খুব অল্প কয়েকটি দেশের তালিকায় পড়ে গেছে, যাদের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি, অথচ তাদের ওপর সবচেয়ে বেশি হারে শুল্ক আরোপ হয়েছে। এখন তাদের বাস্তববাদী পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং বিশ্বাস পুনর্গঠন করতে হবে।"
এই শুল্ক তিন সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর হবে। যদিও এটা হঠাৎ আঘাতের মতো এসেছে, তবে গত কিছু সপ্তাহ ধরেই দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্যের আভাস ছিল।
মাত্র গত সপ্তাহেই ট্রাম্প হুমকি দেন যে, রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার কারণে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা অচলাবস্থায় পড়েছে এবং তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে "মৃত অর্থনীতি" বলে উল্লেখ করেন।
গত বছর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল প্রায় ২১২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ভারতে অনুকূলে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। প্রধানমন্ত্রী মোদী এর আগেও বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে তিনি এই বাণিজ্য দ্বিগুণ করে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চান।
বাণিজ্য আলোচনার অংশ হিসেবে নয়াদিল্লি জানিয়েছিল, তারা মার্কিন শিল্প পণ্যের ওপর কর তুলে নেবে এবং প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে কেনাকাটা বাড়াবে। রয়টার্স জানায়, ভারত গাড়ির ওপর করও কিছুটা কমানোর প্রস্তাব দেয়, যদিও দেশের ভিতরের শক্তিশালী অটো লবির পক্ষ থেকে চাপ ছিল এর বিরুদ্ধে।
তবে ভারত কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারে রাজি হয়নি, কারণ এই দুটি খাত সরাসরি কোটি কোটি দরিদ্র ভারতীয়ের জীবিকার সঙ্গে জড়িত। এই অবস্থান কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশের মতো।
নিউইয়র্কের এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া কার্যক্রমের পরিচালক ফারওয়া আমের বলেন, যেটা এক সময় বাণিজ্য আলোচনা ছিল, সেটি এখন ভূরাজনৈতিক রূপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে মে মাসে হওয়া সংঘর্ষের অবসান কিভাবে হয়েছে তা নিয়েও দ্বিমত আছে। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন। কিন্তু ভারত বারবার বলেছে, এই সংঘাতে ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা ছিল না এবং মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে কোনো কথাও হয়নি।
পাকিস্তান এদিকে ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ ও তেলের খাতে চুক্তি করেছে। বাইডেন সরকারের অধীনে দ্বিধাদ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করছে।
এই সব মিলিয়ে নয়াদিল্লির মধ্যে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। আমের বলেন, "এটা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক বড় পরীক্ষা। প্রশ্ন হলো, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেও কি তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারবে?"
ভারত বুধবারের শুল্ককে "অন্যায়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত" বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি তাদের ১৪০ কোটির জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই করা হয়েছে।
আমের বলেন, "ভারত দুর্বল দেখাতে চায় না। মোদী বিশ্বে একটা অবস্থান তৈরি করেছেন, আর সেই অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করবেন। তারা বলবে, জাতীয় নিরাপত্তা তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে চালিত করছে।"
মন্টেরের মিডলবারি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অধ্যাপক রবার্ট রগোস্কি বলেন, তিনি মনে করেন "অচিরেই খুব সৃজনশীল কূটনীতি" দেখা যাবে, কারণ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে।
এই মুহূর্তে ভারত তার অন্যান্য বাণিজ্য চুক্তি দৃঢ় করতে পারে, বলেন আমের। যেমন গত মাসে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে চুক্তি আলোচনায় আছে।
ভারত এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টাও করছে, যেমনটা সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান করেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যেসব দেশ মিত্র ছিল, তাদের ওপরও শুল্ক আরোপ করেছেন। মোদী মাসের শেষে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এটা হবে চীনে তার প্রথম সফর ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের পর।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ভারতের জন্য এমন সময় এসেছে, যখন দেশটি নিজেকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাচ্ছে, বিশেষ করে চীনের বিকল্প হিসেবে। এপ্রিল মাসে অ্যাপল বলেছিল, আগামী বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য সব আইফোন ভারতে তৈরি করা হবে। যদিও ইলেকট্রনিক পণ্য এই শুল্কের আওতার বাইরে, তবু ৫০ শতাংশ শুল্ক দেওয়া দেশের ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নাজিবুল্লাহ বলেন, "এটা কেবল অনিশ্চয়তা বাড়ায়, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে আগেই অনুভূত হচ্ছিল ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে। ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি বন্ধু-নির্ভরতা নয়, নিজস্ব উৎপাদনে বিশ্বাস করেন।"