Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

ধ্বংসস্তূপ, ধুলো আর কবরের প্রান্তর—আকাশ থেকে দেখা গাজা

Icon

লোরেঞ্জো টন্ডো

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১১:২৩ এএম

ধ্বংসস্তূপ, ধুলো আর কবরের প্রান্তর—আকাশ থেকে দেখা গাজা

গাজার আকাশে উড়ন্ত একটি জর্ডানিয়ান বিমান থেকে তোলা। ছবি: আলেসিও মামো

আকাশ থেকে তাকালে গাজা যেন কোনো প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। চারদিকে ভাঙা দালান, ছিন্নভিন্ন দেয়াল, অগোছালো রাস্তাঘাট, বিস্ফোরণে তৈরি গর্ত আর ধুলোময় এক মরুভূমি। গাজা যেন এক মৃত্যুর ভূখণ্ড।

কিন্তু এখানে কোনো ভূমিকম্প হয়নি, হয়নি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সময়ও এভাবে গাজাকে ধ্বংস করেনি।

মাত্র দু’বছর আগেও গাজা ছিল জীবন্ত এক শহর। হ্যাঁ, সমস্যা ছিল, সংকট ছিল, কিন্তু মানুষ চলাফেরা করত, বাজারে ভিড় থাকত, রাস্তাঘাটে শিশুদের হাসি ছড়িয়ে থাকত। সেই গাজা আর নেই। আগ্নেয়গিরির ছাই বা ইতিহাসের পাতা নয়, সেটিকে মুছে দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক অভিযান।

মঙ্গলবার একটি জর্ডানিয়ান সামরিক বিমানে গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক লোরেঞ্জো টন্ডো আর আলেসিও মামো গাজা অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়ে যান। বিমানটি সাহায্য নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই উড়ানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই ধ্বংসস্তূপ দেখা—যেটা সাংবাদিকদের চোখ থেকে অনেক মাস ধরে আড়াল করে রাখা হয়েছে। গত বছরের সাত অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর গাজায় বিদেশি সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ, যা আধুনিক যুদ্ধে বিরল এক ঘটনা।

গাজা সিটি ও উত্তরের ওপর দিয়ে যখন বিমান উড়ে যায়, তখন নিচে চোখ পড়ে ধসে পড়া শহরগুলোর ওপর। ধ্বংসাবশেষ, গর্ত আর ছিন্নভিন্ন রাস্তা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। প্রায় ৬০০ মিটার ওপরে থেকেও কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। কিছু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষ চোখে পড়ে, ছোট একটি দল—মৃত্যুর রাজ্যে জীবনের একমাত্র চিহ্ন।

নুসাইরাত শরণার্থী ক্যাম্পের উপর দিয়ে যখন বিমানটি যায়, তখন সাহায্যের প্যালেট নামিয়ে দেয়া হয়। প্যারাস্যুটে ভর করে তিন টন ত্রাণ পড়ে নিচে। জর্ডানের সেনাবাহিনী জানায়, ২৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ত্রাণ ফেলার কাজের অংশ হিসেবে তারা এই নিয়ে ১৪০ বার নিজেরা এবং আরও ২৯৩ বার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে ত্রাণ সরবরাহ করেছে, সব মিলিয়ে ৩২৫ টন ত্রাণ দেওয়া হয়েছে গাজায়।

কিন্তু মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, এসব অপ্রতুল। বিমান থেকে ফেলা ত্রাণ খুব ব্যয়বহুল, অকার্যকর এবং যেভাবে ট্রাকে ত্রাণ পৌঁছানো যায়, তার তুলনায় অনেক কম। যুদ্ধের ২১ মাসে ১০৪ দিন ধরে ফেলা এই ত্রাণ কেবল চার দিনের খাবারের সমান।

এমনকি এই বিমান থেকে ফেলা ত্রাণ প্রাণঘাতীও হতে পারে। গত বছর অন্তত ১২ জন মানুষ সমুদ্র থেকে খাবার তুলতে গিয়ে ডুবে মারা যান, আর ৫ জনের মৃত্যু হয় যখন তাদের উপর প্যালেট পড়ে।

দক্ষিণে যেতে যেতে দেখা যায় দেইর আল-বালাহ। ২২ মে সেখানকার বারাকা এলাকায় এক শিশুর মৃত্যু হয়। ১১ বছর বয়সী ইয়াকিন হাম্মাদ, যিনি গাজার সবচেয়ে কনিষ্ঠ সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি তার ত্রাণক্যাম্পের পাশে গাছের গায়ে পানি দিচ্ছিলেন। তখনই ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার বাড়ি ধ্বংস হয়।

কিছু দূর এগিয়ে বিমান চলে যায় খান ইউনুসের ওপর দিয়ে, যেটি দীর্ঘদিন ইসরায়েলি বাহিনীর অবরোধে ছিল। এখানেই মারা গেছেন শিশু চিকিৎসক ডা. আলা আল-নাজ্জার। তিনি আল-তাহরির হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন, ডিউটিতে থাকার সময় তার বাড়িতে হামলা হলে তার স্বামী ও ১০ সন্তানের মধ্যে ৯ জন মারা যান।

আকাশ থেকে গাজা ছোট দেখায়। লন্ডনের চেয়েও চার গুণ ছোট এলাকা। এই ছোট্ট ভূখণ্ডেই ইসরায়েলি হামলায় ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়। অনেকে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।

নিচেই কাজ করছেন গার্ডিয়ান সাংবাদিক মালাক এ টান্তেশ। তিনি নিজেই একজন যোদ্ধা ও বেঁচে যাওয়া মানুষ। অনেক সহকর্মী তার সঙ্গে কখনো দেখাও করতে পারেননি, কারণ তিনি গাজা ছাড়তে পারেননি। বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, খাবার পানি নেই, পরিবার-বন্ধু হারিয়েছেন, ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। আর এই সময়ই তিনি ওপরে থাকা সাংবাদিকদের বার্তা পাঠান।

ফিরতি পথে একজন জর্ডানিয়ান সেনা আকাশের একদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ওটাই রাফা। গাজার দক্ষিণ প্রান্ত। এখানেই মে মাসে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন খাবার সরবরাহের দায়িত্ব নেয়ার পর শত শত মানুষ খাবারের জন্য হুড়োহুড়িতে মারা যান। কাছেই একটি জায়গায়, ২৩ মার্চ, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১৫ জন চিকিৎসক ও উদ্ধারকর্মী নিহত হন, যাদের গণকবরে সমাহিত করা হয়।

যখন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ বিমানঘাঁটিতে সাংবাদিকদের বিমান নেমে আসে, তখন সবার মুখে একই প্রশ্ন—আর কবে দেখা যাবে গাজা? আর কী-ই বা ধ্বংস হবে এরপর, যখন প্রায় সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে?


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন