আল জাজিরার প্রতিবেদন
ইরান থেকে বিতাড়িত আফগানরা খরা, ক্ষুধা ও অবরুদ্ধ জীবনের মুখে

আলেকজান্ডার ম্যাথেউ
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১১:২৫ এএম

ইরান থেকে ফিরে আসা আফগানরা সহায়তার অপেক্ষায়, ২ জুলাই ২০২৫, ইসলাম কালা, আফগানিস্তান। স্থায়ী ঘরবাড়ি না থাকায় অনেকেই এখন সহায়তার জন্য মরিয়া। [ছবি: এলিস ব্লাঞ্চার্ড / গেটি ইমেজেস]
ইসলাম কালার ট্রানজিট ক্যাম্পে বাস থেকে নেমেই ঝলসানো রোদে পুড়ছেন ফাতেমা। সঙ্গে আছে তার তিন সন্তান। তারা ইরান থেকে ফিরেছেন, প্রতিদিন যেভাবে হাজার হাজার আফগান ফিরছেন তাদের মতোই। গত ছয় মাসে প্রায় আট লাখ মানুষ ইরান থেকে আফগানিস্তানে ফিরেছেন। এক কোণে গিয়ে মাটিতে বসে নিজের বিছানার চাদর দিয়ে সন্তানদের রোদ থেকে আড়াল করেন ফাতেমা। জানতে চাইলে বলেন, হয়তো তার ভাই তাদের জায়গা দিতে পারেন গ্রামের বাড়িতে।
এই ক্যাম্পে গরম খাবার আর প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে আফগান রেড ক্রিসেন্ট। কিছু নগদ অর্থ দেয় জাতিসংঘ। কিন্তু একদিন পরই কাউকে কাউকে চলে যেতে হয়। বাস ড্রাইভাররা শহরের নাম ধরে ডাকেন। ফাতেমা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে হারাত প্রদেশের ওবেহ শহরের দিকে রওনা হন। তিন সন্তান পিছনে পিছনে হাঁটে। ফাতেমা বলেন, ইরানে থেকে কার্পেট বুনতে শিখেছেন, কিন্তু কোনো সরঞ্জাম আনতে পারেননি। তিনি বলেন, “টাকা ছাড়া আবার কিভাবে সব শুরু করব? আর গ্রামে কে কিনবে আমার বানানো কার্পেট? সেখানকার মানুষ তো নিজেরাই খেতে পায় না।”
ইরান ছাড়ার যন্ত্রণা আলাদা, কিন্তু আসল যুদ্ধ শুরু হয় এখন। গ্রামে গিয়ে ফাতেমার জন্য কোনো চাকরির সুযোগ থাকবে না। নারীদের নিয়োগে নানা নিয়মের কারণে কেউ তাকে কাজ দেবে না। তার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা হবে নিজের কিছু শুরু করা। কিন্তু সেটার জন্য চাই কিছু পুঁজি। ভাইয়ের সহায়তায় বাজারে পণ্য বিক্রির সুযোগ পেলে কিছুটা আশা থাকতে পারে। তবুও এটা হবে কঠিন এক লড়াই। অনেক আফগান নারী এই পথেই হাঁটছেন, ফাতেমাও পারতেন—যদি কোথাও থেকে কিছু ঋণ পেতেন।
কিন্তু তার গ্রামে কেউই কি আদৌ তার পণ্য কিনতে পারবে? আশপাশের মানুষ কৃষিকাজেই নির্ভরশীল। অথচ সেচব্যবস্থা ধ্বংসপ্রায়, খরায় নদী শুকিয়ে গেছে, পাতাল জলও উঠে আসছে না। ফলে চাষ করা যাচ্ছে না। পুরুষেরা শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন খুঁটিনাটি কাজের আশায়, কিন্তু সেখানে পানির জন্য হাহাকার। কাবুল শহরে অর্ধেকের বেশি গভীর নলকূপ শুকিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে মার্সি কর্পস। আগামী পাঁচ বছরে শহরটিতে পানযোগ্য জল শেষ হয়ে যেতে পারে। এর সমাধান একটাই—বড় বিনিয়োগ দরকার পানি সংরক্ষণ, জলাধার এবং বাঁধ তৈরিতে। কিন্তু আফগানিস্তান সে অর্থ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে।
ফাতেমা যদি কোনোভাবে একটু আয় করতে পারেন, আর পানির কাছাকাছি থাকতে পারেন, তাহলে তিনি সন্তানের পড়াশোনার দিকে মন দিতে পারবেন। মেয়েকে মাদ্রাসায় পাঠাতে হবে, যেটা ইরানের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তবুও কিছু মাদ্রাসায় এখন নানা বিষয় পড়ানো হয়, কিছুটা উচ্চশিক্ষার সুযোগও থাকে। তিনি চাইলে কারিগরি শিক্ষা কিংবা অনলাইন কোর্সে যুক্ত হতে পারেন, যদি সামান্য কিছু বিনিয়োগ করতে পারেন। এসবের পথে নানা বাধা থাকলেও আফগান নারীরা আগেও সেসব পেরিয়েছেন। বিদেশি সহায়তা যদি নীরবে বিকল্প শেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়, তাহলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত তা ছোট পরিসরেই সীমাবদ্ধ।
ফাতেমা যদি নিজের উদ্যোগে কিছু শুরু করতে পারেন, পানি ও শিক্ষা পেতে পারেন—তাহলে কিছুটা আশার আলো দেখা যায়। কিন্তু তা না হলে তার ভবিষ্যৎ হবে কঠিন। তার মতো যারা নতুন ফিরে আসছে, তাদের অনেকেই কদিনের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ব্যবসায় সহায়তা পাচ্ছেন না, পানি না থাকায় গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিতে হচ্ছে। যেখানেই থাকেন, চিকিৎসা সেবা দূরে, ব্যয়বহুল। হয়তো তাকে মেয়েকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিতে হবে, আর ছেলেদের পাঠাতে হবে হালকা শ্রমের কাজে। দেশজুড়ে এমনটাই হচ্ছে। ফাতেমা যদি পারেন, হয়তো আবার ফিরে যেতে চাইবেন ইরানেই।
বিগত চার বছরে আন্তর্জাতিক সহায়তায় সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় হয়েছে। এতেই হাজার হাজার নারীর ছোট ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হতো, কৃষিজমিতে পানি পৌঁছানো যেত, শিক্ষার বিকল্প পথ তৈরি হতো। কিন্তু জরুরি সহায়তার চাপে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগে সেই অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হয়নি। অনেকে আবার ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বৈধতা দিতে চান না বলে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে হাতই দিচ্ছেন না।
এখন প্রয়োজন ভিন্ন পথে হাঁটা। বাজেট কমে এলেও যা আছে, তা দিয়ে স্থানীয়দের নেতৃত্বে জীবিকা, পানি, স্বাস্থ্য আর শিক্ষায় টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এতেই হয়তো ফাতেমাদের ভবিষ্যৎ কিছুটা নিরাপদ হবে।
যদি নীতিগতভাবে এটা যথেষ্ট কারণ না হয়, তাহলে ভাবতে হবে, এ বছরের মতো বড় আকারে ফেরত আসা মানুষদের ব্যর্থ হলে সামনে আরও ভয়াবহ স্রোত দেখা দিতে পারে। এখনই তাদের নিজ দেশে বাঁচার সুযোগ দেওয়া অনেক বেশি যুক্তিসংগত হবে, না হয় ভবিষ্যতে শরণার্থী শিবির ও মানবপাচার ঠেকাতেই খরচ হবে আরও বহু গুণ বেশি।
আলেকজান্ডার ম্যাথেউ: আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট ফেডারেশনের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক।