Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আফ্রিকায় ধনকুবেরদের উত্থানের আড়ালে কোটি মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা

Icon

তাফি মহাকা

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০৭ পিএম

আফ্রিকায় ধনকুবেরদের উত্থানের আড়ালে কোটি মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা

প্রিন্স অ্যান্ড্রু, ইয়র্কের ডিউক, ১ ডিসেম্বর ২০১৫-তে লন্ডনের সেন্ট জেমস প্যালেসে অনুষ্ঠিত লন্ডন গ্লোবাল আফ্রিকান ইনভেস্টমেন্ট সামিটে আলিকো ডাংগোটের সঙ্গে কথা বলছেন \[অ্যান্থনি ডেভলিন–ডব্লিউপিএ পুল/গেটি ইমেজেস]

২০২৫ সালের ৯ জুলাই আমি গভীর হতাশা আর বেদনায় ডুবে গিয়েছিলাম অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট পড়ে। এই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থাটি জানায়, আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী চারজন ধনকুবেরের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫৭.৪ বিলিয়ন ডলার, যা একসাথে ৭৫০ মিলিয়ন আফ্রিকান মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি—মানে প্রায় অর্ধেক আফ্রিকান জনগণের চেয়ে চারজনের সম্পদ বেশি।

অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, এখন আফ্রিকার শীর্ষ ৫ শতাংশ মানুষ প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা বাকি ৯৫ শতাংশের মোট সম্পদের দ্বিগুণেরও বেশি।

এই রিপোর্টের নাম “আফ্রিকার বৈষম্য সংকট ও সুপার-ধনীদের উত্থান”। এতে যাঁদের নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সবার আগে রয়েছেন নাইজেরিয়ার আলিকো ডাংগোটে, যাঁর সম্পদের পরিমাণ ২৩.৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান রুপার্ট ও তাঁর পরিবার—১৪.২ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় স্থানে নিকি ওপেনহেইমার ও তাঁর পরিবার—১০.২ বিলিয়ন ডলার। চতুর্থ স্থানে আছেন মিশরের নাসেফ সাওয়ারিস, যাঁর সম্পদ ৯.৪ বিলিয়ন ডলার।

আমি নিজে সেই ৯৫ শতাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে একজন—যারা স্বপ্ন দেখে, পরিশ্রম করে, কিন্তু সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠার মতো সম্পদ বা সুযোগ পায় না। ২০০০ সালে যখন ২১ শতক শুরু হয়, তখন আফ্রিকায় কোনো বিলিয়নিয়ারই ছিল না। এখন এই মহাদেশে ২৩ জন বিলিয়নিয়ার, যাঁদের অধিকাংশই পুরুষ। তাঁদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে ৫৬ শতাংশ বেড়ে ১১২.৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

আফ্রিকার ধনী-গরিব বৈষম্যের সবচেয়ে প্রকট উদাহরণ আজকের নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আর ডাংগোটে আফ্রিকার সেই ব্যবসায়ী নেতার প্রতিচ্ছবি, যিনি রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে দানবীয় সম্পদের অধিকারী হয়েছেন।

পঁচিশ বছর আগে ডাংগোটে ছিলেন এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোটিপতি। ১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি নাইজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ওলুসেগুন ওবাসানজোর প্রচারে বড় অঙ্কের অনুদান দেন। এক বছর পর ওবাসানজোর সরকার দেশজুড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়। এই সময়েই ডাংগোটে কিনে নেন বেনু সিমেন্ট (২০০০) ও ওবাজানা সিমেন্ট (২০০২)। পরে এই দুটো কারখানা একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে ডাংগোটে সিমেন্ট, যা এখন আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের লাভ করলেও গড় কর হার ছিল মাত্র ১ শতাংশের নিচে। ২০০৭ সালে ডাংগোটে নাইজেরিয়ার সবচেয়ে ধনী উদ্যোক্তা হন।

ওবাসানজোর আমলের এই বিনিময়ভিত্তিক সম্পর্ক পরে নাইজেরিয়ার ব্যবসা ও রাজনীতির এক প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়।

সমালোচকরা বলেন, এই বেসরকারীকরণ ও ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেশন পলিসি প্রতিযোগিতা ধ্বংস করেছে এবং মনোপলি তৈরি করেছে। এতে মূলত লাভবান হয়েছেন রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী—যেমন ডাংগোটে—আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছোট ব্যবসা ও সাধারণ মানুষ।

নাইজেরিয়া একদিকে তেল-গ্যাসসহ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, আবার অন্যদিকে প্রায় ১১২ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দেশটির সবচেয়ে ধনী পাঁচজন ব্যক্তি—যারা ব্যাংক, টেলিকম, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদি খাতে প্রভাবশালী—তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৯.৯ বিলিয়ন ডলার।

এই ‘অলিগার্কি’ বা ধনীদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা কেবল নাইজেরিয়ার নয়, দক্ষিণ আফ্রিকাও একই ধরনের কাঠামোর মধ্যে পড়েছে।

১৯৯৪ সালের ২৭ এপ্রিল বর্ণবৈষম্যের অবসান হওয়ার পর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস চালু করে ব্ল্যাক ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট (বিইই) ও ব্রড-বেইজড বিইই (বিবিইই)। এর লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা, কর্মসংস্থান বাড়ানো ও আয় বণ্টনের ভারসাম্য আনা।

কিন্তু বহু বছর পর নিজেরাই স্বীকার করে এনসি সরকার—এই নীতিগুলো মূলত সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের উপকারে আসেনি, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ক্ষেত্রে।

এই ব্যবস্থায় সামান্য কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসায়ী সফল হয়েছেন, কিন্তু তাঁরা এক ধরনের অলিগার্কি কাঠামোর মধ্যেই কার্যত সুবিধা পেয়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় প্যাট্রিস মোৎসেপেকে, যিনি খনিশিল্পে বিশাল সফলতা পেয়েছেন এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক। তাঁকে কেউ কেউ পরোক্ষভাবে বিবিইই এর সফল ফলাফল হিসেবে দেখেন। কিন্তু সমালোচকরা, যেমন অর্থনীতিবিদ মোএলেটসি মবেকি, বলেন—এই সম্পদ অর্জন সত্যিকারের উদ্যোক্তা মানসিকতার ফল নয়, বরং রাজনৈতিক যোগসূত্রের ফল। মোৎসেপে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার শ্যালক।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার বেকারত্বের হার ছিল ৩২.৯ শতাংশ, অর্থাৎ ৮.২ মিলিয়ন মানুষ কাজ খুঁজছেন। আর বিস্তৃতভাবে দেখলে (নিরুৎসাহিত কর্মপ্রার্থীদেরও ধরলে) এই হার ৪৩.১ শতাংশ। এরই মধ্যে ৩৪.৩ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন।

অন্যদিকে ওপেনহেইমার পরিবার, যাঁদের সম্পদের মূল উৎস ডায়মন্ড খনির ঐতিহাসিক সম্পদ, তাঁদের ধনসম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে বেড়েই চলেছে। হার্ভার্ড গ্রোথ ল্যাবের ২০২৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়—এখনো দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি স্থবির এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। বর্তমান কৌশল জনগণের ক্ষমতায়নের বাস্তবায়নে ব্যর্থ।

সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন এনসি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী—যেমন প্রেসিডেন্ট রামাফোসা, টোকিও সেক্সওয়ালে, সাবেক সংসদ সদস্য সাকি মাকোজোমা এবং ব্রিজেট রাডেবি (মোৎসেপের বোন, এনসি নেতা জেফ রাডেবির স্ত্রী)।

এই এলিট শ্রেণি, যাঁদের বিবিইই-র সুবিধাভোগী হিসেবে দেখানো হয়, প্রকৃতপক্ষে সাধারণ জনগণের চাহিদার প্রতিকূল এক শ্রেণির প্রতিচ্ছবি। সাধারণ মানুষ আজও ক্ষুধা, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাজেট কাট এবং সেবার ঘাটতির মধ্যে দিন কাটায়।

এই একই চিত্র নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডাংগোটের বিপুল সম্পদ একটি সাফল্যের চিহ্ন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তিনি হলেন রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার সুবিধায় গড়ে ওঠা এক ধনকুবেরের প্রতিচ্ছবি। আজ প্রায় প্রতিটি আফ্রিকান দেশেই ডাংগোটে বা মোৎসেপের মতো কেউ না কেউ আছেন—যাঁরা অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায়ের পথে অন্তরায়।

ক্রনিপুঁজিবাদ মানে হচ্ছে বাজার অর্থনীতির বিপরীতে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে মেধা ও উদ্ভাবনের চেয়ে রাজনৈতিক যোগাযোগ বড় ভূমিকা রাখে। এর ফলে জন্ম নেয় দুর্নীতি, অদক্ষতা, বৈষম্য এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে যায়।

কোলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে—যেসব ধনকুবের রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত, তাঁদের সম্পদ জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। অপরদিকে নিরপেক্ষ ধনকুবেরদের প্রভাব সামান্য।

এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক সংস্কার।

আফ্রিকান দেশগুলোর উচিত ধনী ব্যক্তিদের ওপর সম্পদকর আরোপ করে সেই টাকা দরিদ্র অঞ্চলের শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জরুরি সেবায় ব্যয় করা।

অক্সফাম জানায়, ধনীদের সম্পদের ওপর মাত্র ১ শতাংশ কর এবং তাঁদের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর বসালে বছরে ৬৬ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যেতে পারে, যা আফ্রিকার মোট জিডিপির ২.২৯ শতাংশ।

সবচেয়ে বড় কথা, আফ্রিকান দেশগুলোর এখন দরকার এমন অর্থনৈতিক নীতি, যা সমতা, দারিদ্র্য হ্রাস এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

আমরা, সেই উপেক্ষিত ৯৫ শতাংশ মানুষ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অলিগার্কির বিরুদ্ধে একজোট হয়েছি। [আল জাজিরা থেকে]

তাফি মহাকা একজন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন