Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আল জাজিরার মতামত প্রতিবেদন

জাতিবিদ্বেষী দুঃস্বপ্নে ঢুকে পড়ছে যুক্তরাজ্য

Icon

তারিক মাহমুদ

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১১:৩০ এএম

জাতিবিদ্বেষী দুঃস্বপ্নে ঢুকে পড়ছে যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যের রদারহ্যামে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, অভিবাসনবিরোধী দাঙ্গার সময় এক বিক্ষোভকারী ময়লার বাক্স ছুঁড়ে মারছে [হলি অ্যাডামস/রয়টার্স]

সাউথপোর্ট হামলার এক বছর পেরিয়ে গেছে। সেই হামলার পর যুক্তরাজ্যের রাস্তায় শুরু হয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী দাঙ্গা। মিথ্যা গুজব রটে গিয়েছিল যে হামলাকারী একজন মুসলমান। সেই গুজবের জেরে ক্ষিপ্ত জনতা মসজিদ, মুসলমানদের দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও যাকে মুসলমান মনে হয়েছে তাকেই আক্রমণ করেছে।

এই দাঙ্গার সময়েই আমি আমার উপন্যাস দ্য সেকেন্ড কামিং শেষ করছিলাম। এই উপন্যাসের কাহিনি এক ভবিষ্যতের ইংল্যান্ডকে ঘিরে, যেখানে এক খ্রিস্টান মিলিশিয়া ইংরেজ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে লন্ডন দখল করে, ইসলাম নিষিদ্ধ করে এবং মুসলমানদের বার্মিংহামে উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে দেয়। যখন আমি শেষ অধ্যায়গুলো লিখছিলাম, তখন বুঝতে পারলাম আমার উপন্যাসের সেই ভয়ানক ভবিষ্যৎ আজকের বাস্তবের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।

এই কল্পিত জগৎ নির্মাণে আমি যেসব দৃশ্য কল্পনা করেছি, তার অনুপ্রেরণা এসেছে আমার নিজের শৈশবের ইংল্যান্ড থেকে, যেখানে বর্ণবাদী সহিংসতা ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। সাদা বর্ণের কিশোরদের দল রাতের বেলা পাব বন্ধ হওয়ার পর আমাদের খুঁজে বেড়াত, তারা একে বলতো ‘পাকি পেটানো’। ছুরি দিয়ে আক্রমণ আর পেট্রল বোমা ছোঁড়া খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। তখনকার ডানপন্থী দলগুলো—ন্যাশনাল ফ্রন্ট আর ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি—ঘন ঘন বলতো, আমাদের মতো কালো মানে অশ্বেতচর্মা ‘বিদেশিদের’ ফেরত পাঠাতে হবে।

স্কুলে যেতেও আতঙ্কে থাকতে হতো, কারণ রাস্তা ধরে যেতে হতো বর্ণবাদী ছেলেমেয়েদের ভিড় পেরিয়ে। খেলার মাঠেও তারা আমাদের ঘিরে ধরে বর্ণবাদী গান গাইত। ছাত্রাবস্থায় কতবার যে মেরে ফেলা হয়েছে তার হিসেব রাখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। স্কুলে, রাস্তায়, পাবের ভেতরে বা বাইরে, যেকোনো জায়গায় শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছি।

আমি তখন পূর্ব লন্ডনে থাকতাম। ব্রিক লেনের তরুণদের সঙ্গে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। হাতে-হাতেই লড়তে হতো বর্ণবাদীদের দলবল ঠেকাতে। শুধু ব্রিক লেনেই না, দেশের নানা জায়গায় একই রকম দৃশ্য। ন্যাশনাল ফ্রন্ট আর ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টি শত শত মিছিল করেছে, যার পেছনে দৌড়েছে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী দলগুলো।

এই সময়ই আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ‘বিস্ফোরক তৈরির ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগে। দুধের বোতলে পেট্রল ভরে আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। এই ঘটনাই ‘ব্র্যাডফোর্ড ১২’ নামে পরিচিত হয়। ব্রিক লেন বা ব্র্যাডফোর্ডের এই সংগ্রাম ছিল বৃহত্তর এক আন্দোলনের অংশ, যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল বর্ণবৈষম্য আর ডানপন্থী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়া।

তখনকার রাস্তায় চলা সহিংসতা ছিল ভয়াবহ, কিন্তু সমাজের প্রান্তিক অংশ থেকেই এসেছিল। শাসক শ্রেণি এই সহিংসতায় পরোক্ষভাবে জড়িত থাকলেও, তারা প্রকাশ্যে এই দলগুলোর পাশে দাঁড়াত না। যেমন, ১৯৭৮ সালে মার্গারেট থ্যাচার, তখন কনজারভেটিভ দলের প্রধান, বলেছিলেন—“মানুষ সত্যিই ভয় পাচ্ছে, মনে করছে এই দেশটা যেন অন্য সংস্কৃতির মানুষের দ্বারা প্লাবিত হয়ে যাবে।” এ কথাটি ছিল বর্ণবাদী জনতার প্রতি এক ধরনের ইঙ্গিত, তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থ্যাচার এসব দল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতেন।

আজ সেই দূরত্ব আর নেই। লেবার পার্টির কেয়ার স্টারমারসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখন নিয়মিতভাবে ডানপন্থী ভাষা ব্যবহার করেন, আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেন। তার আগের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যানও একই রকম ছিলেন। ব্রেভারম্যান মিথ্যা বলেছিলেন যে যৌন নিপীড়ন চক্রগুলোতে প্রধানত ব্রিটিশ পাকিস্তানি পুরুষেরা জড়িত, যাদের মূল্যবোধ নাকি ব্রিটিশ মূল্যবোধের সঙ্গে একেবারে সাংঘর্ষিক।

পুরোনো সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বর্ণবাদ আজও আছে, তবে আজকের সবচেয়ে কদর্য রূপ হলো ইসলামবিদ্বেষ। এখন মনে হয়, সেই পুরোনো ‘পাকি পেটানো’ দলগুলো এক নতুন ধর্মযুদ্ধী ঢেউয়ে পরিণত হয়েছে, যারা ইসলামকে সন্ত্রাসের প্রতিরূপ ভাবে, পাকিস্তানিদের যৌন অপরাধের সঙ্গে জড়ায় এবং আশ্রয়প্রার্থীদের দেশ ধ্বংসকারী পরজীবী ভাবে।

এই আবহেই রিফর্ম পার্টি উত্থান ঘটিয়েছে। এই দলের সহজ কিন্তু ঘৃণামূলক ভাষা—ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষ—জনগণের কাছে ‘সত্যবাদী বিকল্প’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন এই দল ভোটে এগিয়ে, তাদের সমর্থন ৩০ শতাংশ, যেখানে লেবার ২২ শতাংশ আর কনজারভেটিভ ১৭ শতাংশ।

এই পরিস্থিতিতে, যখন দাঙ্গার বর্ষপূর্তি চলছে, তখন ইকোনমিস্ট পত্রিকা একটি জরিপ চালিয়েছে যা অর্থনৈতিক মন্দা বা সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে নয়, বরং জাতি নিয়ে। জরিপে দেখা গেছে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মনে করে বহুসংস্কৃতিবাদ ক্ষতিকর, আর ৭৩ শতাংশ মানুষ মনে করে নতুন করে জাতিগত দাঙ্গা হবে।

দেশের ভেতরের এই সহিংসতা ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। আজকের এই বর্ণবাদ সেই পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী ধারণা থেকেই জন্ম নিচ্ছে—‘বর্বরদের’ বশ মানাতে হবে, যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসনে করেছিল ব্রিটেন। তখন যে বর্ণবাদ সাম্রাজ্যকে একত্র করেছিল, এখন তা ফিরে এসেছে।

এই চিন্তাধারা আজকের রাস্তায় মুসলিমবিরোধী হামলায়, ফিলিস্তিনের সমর্থকদের ওপর দমন-পীড়নে, এবং গাজায় শিশু হত্যা, হাসপাতাল ধ্বংসের মধ্যেও ইসরায়েলকে সমর্থন করার রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে শিখেছে কীভাবে পুরো জনগোষ্ঠীকে অমানবিকভাবে দেখা যায়, কীভাবে লুটপাট, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে ন্যায্যতা দেওয়া যায়। এই কারণেই আজ তারা গণহত্যাকারী ইসরায়েলের সঙ্গে একজোট।

এই প্রেক্ষাপটে, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একত্রিত হয়েছে। যদিও তারা গণহত্যা থামাতে পারেনি, তারা শাসক শ্রেণির ভণ্ডামিকে প্রকাশ্যে এনেছে। শুধু এই ঐক্য ও বর্ণবাদবিরোধী প্রতিরোধই পারে আমার উপন্যাসের ভয়ংকর ভবিষ্যৎকে বাস্তব হওয়া থেকে থামাতে।

* তারিক মাহমুদ একজন লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ১৯৮২ সালের ‘ব্র্যাডফোর্ড ১২’ মামলার প্রধান অভিযুক্তদের একজন ছিলেন। তিনি চরম ডানপন্থী আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কমিউনিটি প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কিন্তু সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত অভিযোগ থেকে খালাস পান।

তার প্রথম উপন্যাস হ্যান্ড অন দ্য সান (১৯৮৩/২০২৩) তুলে ধরে ১৯৭০–৮০ দশকের ব্রিটিশ অভিবাসীদের বর্ণবৈষম্যবিরোধী লড়াই। তার সাম্প্রতিক উপন্যাস দ্য সেকেন্ড কামিং (২০২৪) এক ভয়াবহ ব্রিটেনকে কল্পনা করে যেখানে চরম ডানপন্থীরা রাষ্ট্র দখল করেছে। তার নতুন উপন্যাস সিং টু দ্য ওয়েস্টার্ন উইন্ড, ভার্সো, ২০২৫—যুদ্ধ ও বর্ণবৈষম্যের নিরবচ্ছিন্ন চক্রের পটভূমিতে লেখা।

তিনি ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পুরস্কারজয়ী তথ্যচিত্র ইনজাস্টিস সহ-নির্দেশনা দেন। ‘ব্র্যাডফোর্ড ১২’-এর ওপর তার নতুন চলচ্চিত্র এই বছর মুক্তি পাবে। তারিক মাহমুদ আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ বৈরুতে শিক্ষকতা করেন। তার কাজ একত্র করে প্রতিবাদ, শিল্প ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন