ট্রাম্প প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন, গাজায় সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন যে গাজায় সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে। তিনি বলেছেন, ইসরায়েল যেন গাজার মানুষদের জন্য প্রতিটি আউন্স খাবার ঢুকতে দেয়। ব্রিটেন সফরে এসে ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথারও বিরোধিতা করেন। নেতানিয়াহু দাবি করেছিলেন, গাজায় ক্ষুধা চলছে এমন কথা পুরোপুরি মিথ্যা।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এল, যখন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জানাচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের কারণে প্রায় সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ হয়ে আছে এবং বহু ফিলিস্তিনি অনাহারে মারা যাচ্ছেন।
স্কটল্যান্ডের ট্রাম্প টার্নবেরি গলফ রিসোর্টে ৭০ মিনিটের এক বিশৃঙ্খল সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, টেলিভিশনে যেটা দেখছি, সেটা স্পষ্ট করে বলে দেয় যে ওখানে শিশুদের অবস্থা খুব খারাপ, ওরা খুব ক্ষুধার্ত। এরপর তিনি বলেন, এটা সত্যিকারের দুর্ভিক্ষ। আমরা এদের বাঁচাতে পারি। আমরা বিষয়টিতে আরও সক্রিয় হচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমরা টাকা দিচ্ছি, খাবার দিচ্ছি। আমি চাই নিশ্চিত করা হোক, ওরা যেন প্রতিটি আউন্স খাবার পায়।
গাজা নিয়ে নেতানিয়াহুর সাথে আলাপ হলে কী বলবেন জানতে চাইলে ট্রাম্প বলেন, আমি ইসরায়েলকে বলেছি, আমি বিবিকে বলেছি, হয়তো এবার একটু অন্যভাবে বিষয়টা করতে হবে।
তিনি হামাসকেও সমালোচনা করে বলেন, তারা এখনও জিম্মিদের মুক্তি দেয়নি এবং তাদের সঙ্গে কাজ করাও খুব কঠিন।
এই সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। গাজা পরিস্থিতি নিয়ে স্টারমার ট্রাম্পকে আলাদাভাবে কথা বলেছিলেন বলে জানায় ব্রিটিশ সরকারি সূত্র। সংবাদ সম্মেলনে স্টারমার বলেন, গাজায় যা হচ্ছে তা একেবারে ভয়াবহ এবং ব্রিটিশ জনগণ এতে ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, অবিলম্বে সেখানে যুদ্ধবিরতি দরকার।
ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ইউক্রেনের বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ বন্ধ না করলে ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে রাশিয়ার বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা অনেকবার সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম, কিন্তু তারপরও পুতিন কিয়েভ বা অন্য শহরে রকেট ছুড়ে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। এটা কোনো সমাধান না।
দেশি রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করেন ট্রাম্প। তিনি স্টারমারকে কর কমাতে এবং অবৈধ অভিবাসন বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বলেন, যাতে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে জিততে পারেন। ট্রাম্প বলেন, কর কমায় যে, জ্বালানির দাম কমায়, যুদ্ধে না জড়ায়, আর অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেয়, সেই জিতবে।
ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, তারা গাজার তিনটি এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে লড়াই বন্ধ রাখবে এবং সুরক্ষিত পথে ত্রাণ প্রবেশ করতে দেবে। যুক্তরাজ্য বলেছে, তারা জর্ডানের সঙ্গে সমন্বয় করে গাজায় বিমান থেকে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।
কিন্তু সোমবার দক্ষিণ গাজায় এক ত্রাণ বহরে গুলি চালায় ইসরায়েলি সেনারা। এতে অন্তত ২৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে চার শিশু ছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, সোমবার তাদের যে ৫৫টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছিল, তার সবগুলোই ক্ষুধার্ত মানুষেরা ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই লুট করে নেয়। অপর এক কর্মকর্তা বলেন, মাটিতে কিছুই বদলায়নি, কোনো বিকল্প পথও খোলা হয়নি।
সোমবার সারাদিনে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন বলে জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। নিহতদের মধ্যে এক গর্ভবতী নারী ও তার সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুও ছিল, যাকে মৃত অবস্থায় প্রসব করানো হয়েছিল।
স্টারমার জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকেলে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক হবে। যুক্তরাজ্য ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে একটি শান্তি পরিকল্পনা তৈরি করছে, যা ওই বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
এম্যানুয়েল ম্যাক্রোঁ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর যুক্তরাজ্যে ২২০ জন এমপি স্টারমারকে অনুরোধ জানিয়েছেন যেন অবিলম্বে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ট্রাম্প যদিও এ নিয়ে আপত্তি জানাননি, তবে নিজে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষেও কোনো মন্তব্য করেননি।
ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গাজায় বাধাহীনভাবে সাধারণ মানুষের জন্য হাঁটাপথে প্রবেশযোগ্য খাবার বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করবে, যদিও কীভাবে এটি কার্যকর হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি।
সোমবার দুপুরে ট্রাম্পের আবেরডিনশায়ারের গলফ কোর্সের কাছাকাছি বালমেডি গ্রামে প্রায় একশো প্রতিবাদকারী জড়ো হন। তারা ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে “তুমি এখানে স্বাগত নও” স্লোগান দিতে থাকেন।
এডিনবরো থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কাই কলিন বলেন, গাজায় যা হচ্ছে তা যদি আমার নাতিদের সঙ্গে হতো, আমি চাইতাম অন্য মানুষরা তাদের পক্ষে দাঁড়াক।
বিক্ষোভকারীদের অনেকেই গাজার দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করলেও অনেকে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি, ট্রান্সজেন্ডার অধিকার হরণ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল কাটছাঁট নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেক প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানে ট্রাম্পকে নারী বিদ্বেষী ও নিপীড়নকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়।
চার সন্তানের জননী জেনা হারপিন, যিনি পোর্টসয় থেকে এসেছেন, বলেন, ট্রাম্পের সফরে স্কটিশ ও ব্রিটিশ সরকার যে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে, তা দেখে তিনি ঘৃণা অনুভব করছেন। স্থানীয় পরিষদগুলো যখন জনসেবা খাতে কাটছাঁট করছে, তখন এই খরচ তিনি মেনে নিতে পারছেন না।
ট্রাম্পের আগমনের আগেই পুরো গ্রামজুড়ে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সমুদ্রতীর বন্ধ করে দেওয়া হয়, বালির পাহাড়ের ওপর দেখা যায় স্নাইপার।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান