Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আল জাজিরার বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডিত নাগরিকদের ঠাঁই কি এখন আফ্রিকার ছোট দেশগুলো?

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১:১৬ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডিত নাগরিকদের ঠাঁই কি এখন আফ্রিকার ছোট দেশগুলো?

সেনেগাল, গিনি-বিসাউ, মৌরিতানিয়া, লাইবেরিয়া ও গ্যাবনের নেতারা ৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন হোয়াইট হাউসে, ওয়াশিংটন ডিসি ছবি: কেভিন লামার্ক / রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীরা অভিযোগ তুলেছেন, তিনি আফ্রিকার দেশগুলোকে দণ্ডপ্রাপ্ত অভিবাসীদের জন্য “ডাস্টবিন” বানাচ্ছেন। তারা বলছেন, যেসব অপরাধীকে নিজ নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে রাজি নয়, ট্রাম্প তাদের আফ্রিকার ছোট দেশগুলোতে পাঠাচ্ছেন। সম্প্রতি পাঁচজন অপরাধীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসওয়াতিনিতে পাঠানো হয়েছে।

১৬ জুলাই একটি বিশেষ উড়োজাহাজ এসওয়াতিনিতে নামে। উড়োজাহাজটিতে ছিলেন ভিয়েতনাম, জামাইকা, লাওস, কিউবা ও ইয়েমেনের পাঁচ নাগরিক। এদের সবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ শিশু ধর্ষণ, হত্যা, ডাকাতি এবং গ্যাং সংশ্লিষ্ট অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন। একজনের ২৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছিল।

এই deportation ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের ‘তৃতীয় দেশ’ পরিকল্পনার অংশ। এর লক্ষ্য, যেসব অভিবাসীদের নিজ দেশ ফেরত নিতে রাজি নয়, তাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো।

এসওয়াতিনি হচ্ছে আফ্রিকার শেষ রাজতান্ত্রিক দেশ, যেখানে এখনও রাজা সব ক্ষমতার মালিক। বর্তমানে রাজা হচ্ছেন এমসোয়াতি তৃতীয়। দেশটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিকের মাঝে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ি রাজ্য। একসময় ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা এই দেশটির নাম ছিল সোয়াজিল্যান্ড। ২০১৮ সালে রাজা নিজেই দেশের নাম বদলে এসওয়াতিনি রাখেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের তরফে ট্রিশিয়া ম্যাকলাফলিন জানিয়েছেন, এই পাঁচ অপরাধী এতটাই ‘বর্বর’ ছিল যে তাদের নিজ নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়নি। তিনি এক পোস্টে লেখেন, “এই বিকৃত অপরাধীরা মার্কিন জনগণের জন্য হুমকি ছিল, এখন তারা আমাদের মাটি থেকে দূরে।”

এসওয়াতিনির সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তিতে পৌঁছেছে, যার মাধ্যমে এসব দণ্ডিত অভিবাসীদের রাখার ব্যবস্থা করা হবে। যদিও চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি, দেশটির সরকারের মুখপাত্র থাবিলে ম্ডলুলি বলেছেন, “সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় রেখে তৃতীয় দেশের এই বন্দিদের পৃথকভাবে রাখা হবে।”

তবে দেশটির বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের একাংশ এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। পিপলস ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট বা পুডেমোর সহ-সভাপতি ওয়ানদিলে ডলুডলু বলেন, “এসওয়াতিনির সার্বভৌমত্ব ও জনগণের মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত এসেছে। আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধীদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে অথচ স্বাস্থ্যখাতে বড় সংকট চলছে।”

ডলুডলু আরও বলেন, “এই বন্দিরা পুরনো, ভাঙাচোরা, অপর্যাপ্ত জেলখানাগুলোয় জায়গা নেবে। ইতোমধ্যেই আমাদের কারাগার ১৭০ শতাংশ ক্ষমতার বেশি বন্দি বহন করছে।”

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার লিটিগেশন সেন্টার এবং সোয়াজিল্যান্ড রুরাল উইমেনস অ্যাসেম্বলির মতো সংস্থাগুলো আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক কনফ্লিক্ট গ্রুপের বিশ্লেষক ড্যানিয়েল আকেচ বলেন, “অনেক আফ্রিকান দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে এসব বন্দিকে গ্রহণ করছে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তে মানবাধিকারের বিষয়টি পুরো উপেক্ষিত হচ্ছে।”

বিদেশনীতি বিশ্লেষক ক্রিস ওগুনমোডেদে বলেন, “এসওয়াতিনি ও দক্ষিণ সুদান মতো ছোট, দুর্বল দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগ সহজ। তারা চুক্তির শর্ত, বন্দিদের পরিস্থিতি, কনস্যুলার সহায়তা কিংবা তথ্য জানানো—কোনোটাই ঠিকমতো করছে না।”

এসওয়াতিনির সরকার অবশ্য বলেছে, “এই পাঁচজন বন্দি আমাদের দেশের জন্য হুমকি নয়। তাদের আলাদা ইউনিটে রাখা হবে যেখানে এমন অপরাধীদের রাখা হয়।” তবে কবে নাগাদ তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে সে বিষয়ে কোনো সময়সীমা জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসন শুধু এসওয়াতিনি নয়, আরও কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সঙ্গে একই রকম চুক্তির চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে লাইবেরিয়া, সেনেগাল, গিনি বিসাউ, মৌরিতানিয়া ও গ্যাবন। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে এসব দেশের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে।

ট্রাম্পের অভিবাসন বিষয়ক উপদেষ্টা টম হোম্যান বলেন, “যারা আমাদের দেশের জন্য হুমকি, তাদের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করার সুযোগ দেওয়া হবে না। আমরা তাদের তৃতীয় কোনো নিরাপদ দেশে পাঠিয়ে দেব। আমরা সেটাই করছি।”

রুয়ান্ডা জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনা চলছে। তবে নাইজেরিয়া জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে কোনো চুক্তিতে যায়নি।

এ ধরনের নীতিমালার উদাহরণ আগেও আছে। যুক্তরাজ্য ২০২২ সালে রুয়ান্ডার সঙ্গে এমন চুক্তি করেছিল, যেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানো হতো। যদিও ২০২৩ সালে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট এই নীতি বাতিল করে দেয়। এরপর নতুন আইন করে রুয়ান্ডাকে “নিরাপদ দেশ” ঘোষণা করা হয়।

তবে ২০২৪ সালে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ওই চুক্তি বাতিল করেন। যদিও তিনি পরে জানান, তিনি এখনও কিছু দেশে “রিটার্ন হাব” গড়ার পরিকল্পনা করছেন।

একই ধরনের নীতি ইসরায়েলও অনুসরণ করেছিল ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তারা আফ্রিকার শরণার্থীদের রুয়ান্ডা ও উগান্ডায় পাঠাতো এবং প্রত্যেককে ৩,৫০০ ডলার করে দিতো। কিন্তু ২০১৮ সালে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত এটাকে বেআইনি বলে রায় দেয়।

ক্রিস ওগুনমোডেদে বলেন, “যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও এখন যুক্তরাষ্ট্র এই অভিবাসন সমস্যা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা হলো রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের এক পদ্ধতি।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এখন গাজর ও লাঠির নীতি অনুসরণ করছে—একদিকে সুবিধা দেবে, অন্যদিকে চাপ দেবে। দুর্বল দেশগুলো এতে পড়ে যাচ্ছে।”


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন