Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদন

দীর্ঘদিনের ক্ষুধায় গাজার রাস্তায় রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকছে ফিলিস্তিনিরা

Icon

মোহাম্মদ আল-হাজ্জার ও মাহা হুসেইনি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৬ এএম

দীর্ঘদিনের ক্ষুধায় গাজার রাস্তায় রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকছে ফিলিস্তিনিরা

ক্ষুধায় কাহিল দুই বছরের ফিলিস্তিনি শিশু ইয়াজান গাজার পশ্চিমে আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে তাঁদের বিধ্বস্ত বাড়িতে ভাইয়ের পাশে বিছানায় শুয়ে আছে, ২৩ জুলাই ২০২৫ (এএফপি/ওমর আল-কাত্তা)

আকরাম বাশীরের ছোট ছোট সন্তান ক্ষুধায় কাঁদে।

তাঁর করার কিছু নেই, শুধু বুকে জড়িয়ে বলেন, “একদিন এই অবরোধ শেষ হবে, তখন তোমরা যা খেতে চাও, খেতে পারবে।”

তিন সন্তানের এই ফিলিস্তিনি বাবা জানেন, এই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারবেন না।

তিনি বলেন, “আমার হাতে কিছুই নেই। আমি কেবল মানসিকভাবে সান্ত্বনা দিই। বলি, ইনশাল্লাহ একদিন পরিস্থিতি ঠিক হবে, খাবার আসবে। আর কোনো উপায় নেই।”

আকরাম বাশীরের বয়স ৩৯ বছর। তিনি গাজার কেন্দ্রীয় এলাকা দেইর আল-বালাহ-তে থাকেন। প্রতিদিন ছুটে বেড়ান খাবারের খোঁজে। তাঁর স্ত্রী, তিন সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা – সকলের মুখে যেন একটা আশার অপেক্ষা। বাবা-মায়ের শরীর খুব খারাপ, দিন দিন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

গাজার প্রায় ২১ লাখ মানুষের মতোই বাশীর ও তাঁর পরিবার মার্চ থেকে ইসরায়েলি অবরোধে আটকা পড়ে আছেন। পুরোপুরি খাদ্য ও জলের সরবরাহ বন্ধ।

অনেক সময় তাঁদের ভাগ্যে এক বেলার খাবার জোটে, আবার অনেক দিন তাও জোটে না।

তিনি বলেন, “আমার সন্তানদের মধ্যে অনেক কিছু বদলে গেছে। ওরা শুকিয়ে যাচ্ছে, সারাদিন ঘুমাচ্ছে, মনোযোগ দিতে পারছে না। সারাক্ষণ শুধু খাবার নিয়ে ভাবছে, বিশেষ করে মিষ্টি কিছু খাওয়ার কথা। আমাদের বলে, ‘আমরা ক্ষুধার্ত।’”

তিনি জানান, কখনও খাবার পেলেও তা পুষ্টিকর না হওয়ায় সন্তানেরা তৃপ্ত হয় না।

বাশীর বলেন, “ওরা কখনোই পরিপূর্ণ অনুভব করে না। খাবারে কোনো পুষ্টি নেই, কিছুই নেই।”

তিনি বলেন, “আমরাও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছি। সামান্য কাজ করলেই শরীর ভেঙে পড়ে।”

তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, যতটুকু সম্ভব খাবার জোগাড় করে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বেশি চিন্তা বাবা-মাকে নিয়ে। তাঁর বাবার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।

তিনি বলেন, “ওনি কয়েকবার মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। সম্প্রতি পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছেন। দুধ, ডিম, পুষ্টিকর কিছু না থাকায় হাড়ও ঠিকভাবে জোড়া লাগছে না।”

২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সব সীমান্ত সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। খাবার, পানি, শিশুদের দুধ—সবই বন্ধ।

খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, মে মাসেই ৫ লাখের বেশি মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ছিলেন। তারপর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

আকরাম বাশীর বলেন, “অবরোধ শুরু হয়েছিল রমজানের শুরুতেই। কিন্তু দেড় মাস আগে যখন মজুদ করা শেষ হয়ে গেল, তখন পরিস্থিতি একেবারে ভয়াবহ হয়ে উঠল। একটা পরিবারে বাচ্চারা থাকলে, খাদ্য মজুদ কখনই বেশি দিন থাকে না।”

বসেম মুনির আল-হিন্নাওয়ি বলছেন, খাবারের সংকট তাঁর পরিবারে আরও আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের এই বাসিন্দার বয়স ৩২ বছর। তিনি এখন একাই দুই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। যুদ্ধের শুরুতেই তাঁর বাবা নিহত হয়েছেন। এখন তিনি দেখেন তাঁর মা, বোন, ভাই, স্ত্রী ও এক বছরের সন্তানকে।

তিনি বলেন, “গত এক মাসে আমরা মাত্র চার-পাঁচ দিন পরপর একবার রুটি খেতে পেরেছি। অনেক দিন তো শিশুদের ক্ষুধা কমাতে সামান্য এক টুকরো বিস্কুট কিনেছি। ডাল পাওয়া গেলে ডালের স্যুপ বানাই।”

তিনি জানান, যুদ্ধের শুরুর দিকেও ক্ষুধা কষ্টদায়ক ছিল, কিন্তু এখন অপুষ্টিজনিত ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, “আমি এখন খুব দুর্বল। মাথা ঘোরে, শরীর কাঁপে, ৩৯ কেজি ওজন কমেছে। আমার ভাইবোনরাও ১৫ থেকে ২০ কেজি করে ওজন হারিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমার বোন মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যায়, হাসপাতালে নিতে হয়। আমার স্ত্রী সন্তানকে দুধ খাওয়ায়, তাঁর শারীরিক অবস্থাও ভয়াবহ। সামান্য ঘরের কাজও করতে পারেন না।”

যখনই হিন্নাওয়ি অল্প কিছু খাবার জোগাড় করতে পারেন, সবই শিশুদের জন্য তুলে রাখেন। বড়রা শুধু পানি আর লবণ খেয়ে কাটান।

তিনি বলেন, “আমি পাঁচবার সাহায্যের খোঁজে গিয়েছিলাম। ট্যাংক আর ড্রোন থেকে গুলি ছুঁড়েছে, জীবন ঝুঁকিতে পড়েছি। তবু একবারও খাবার পাইনি। অনেক দিন গেছে, চার দিন ধরে বড়রা কিছু না খেয়ে শুধু লবণ পানি খেয়ে কাটিয়েছে।”

তাঁর মা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বিশ মিটার হাঁটতেও পারেন না, অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১১৩ জন ফিলিস্তিনি—including ৮১ শিশু—ক্ষুধায় মারা গেছেন।

তারা বলছে, ২৮ হাজার malnutrition-এর কেস নথিভুক্ত হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

হিন্নাওয়ি বলেন, “বড়রা কখনো কখনো এই কষ্ট সহ্য করতে পারে। কিন্তু একজন ছোট শিশু বুঝবে কীভাবে যে তাকে ইচ্ছা করে না খেতে দেওয়া হচ্ছে?”

“ওরা তো ভাবে, আমরা—মা-বাবা—চাই না যে ওরা খাক। এটা কীভাবে বোঝাবে?”

বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য প্রায় উধাও হয়ে গেছে। অনেক পরিবার একটানা কয়েক দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষেরা ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।

হিন্নাওয়ি বলেন, “শেখ রাদওয়ানে আমি এখন থাকি। গতকাল হেঁটে যাওয়ার সময় একজন ৪৫ বছরের নারী রাস্তার মাঝখানে পড়ে যান ক্ষুধায়।

লোকজন তাঁকে তুলে পাশের ফুটপাথে বসায়। কেউ বাড়ি থেকে সামান্য চিনি এনে মুখে দেয়। খুব আস্তে আস্তে তাঁর জ্ঞান ফেরে, উঠে দাঁড়ান।

মানুষ আর পারছে না। খুব বেশি হয়ে গেছে।”

মোহাম্মদ আল-হাজ্জার গাজাভিত্তিক একজন ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক। ২০০৭ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর তোলা ছবি ও প্রতিবেদন বহুবার পুরস্কৃত হয়েছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
মাহা হুসেইনি গাজাভিত্তিক একজন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। তিনি ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ইসরায়েলের গাজা অভিযানের সময় সাংবাদিকতা শুরু করেন। মাহা একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ২০২০ সালে তিনি মর্যাদাপূর্ণ মার্টিন অ্যাডলার পুরস্কার পান তাঁর সাহসী প্রতিবেদনের জন্য।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন