Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৬ এএম

সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ প্যারিসের এলিসি প্রাসাদে অতিথির আগমনের অপেক্ষায়, ২৩ জুলাই ২০২৫। আবদুল সাবুর/রয়টার্স

একটি পোস্টেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ বদলে দিলেন অনেক কিছু, আবার কিছুই বদলাল না।

সপ্তাহের শেষভাগে গভীর রাতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ ঘোষণা দিলেন, সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। এটি হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ও জি-৭ ভুক্ত প্রথম দেশ হিসেবে এমন স্বীকৃতি। সবাইকে চমকে দিলেন তিনি।

অনেকে আগেই আঁচ করেছিল যে ফ্রান্স এমন পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে ইরান-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধের কারণে সৌদি আরব ও ইউরোপীয় মিত্রদের নিয়ে আয়োজিত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়, যেখানে এই স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল। তাই এই ঘোষণা যে হঠাৎ এলো তা নয়, কিন্তু ঠিক এইভাবে আসবে সেটা কেউ ভাবেনি।

মাক্রোঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বোঝা গেল তিনি মনে করছেন এখনই সঠিক সময়।

এই ঘোষণার ঠিক পরদিন শুক্রবার ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির নেতারা গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের তীব্রতা নিয়ে কথা বলবেন। মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি গাজাবাসী ক্ষুধার তাড়নায় খাবারের খোঁজে গিয়ে মারা গেছেন, আরও অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন অনাহারে।

গাজা সিটির আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে ক্ষুধায় কাতর দুই বছরের শিশু ইয়াজান দাঁড়িয়ে ছিল নিজের বিধ্বস্ত ঘরের ভেতর, পেছন ফিরে। এমন ছবি দেখে অনেকেরই মনে পড়ছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অন্ধকার সময়গুলো।

এই পরিস্থিতিতে মাক্রোঁর স্বীকৃতি সাহসী সিদ্ধান্ত। নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন এর আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ফ্রান্স এই প্রথম বড় শক্তিধর দেশ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নিল।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন, “আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের কথা হয়েছে, আমি নিশ্চিত যে শুধু আমরাই নই, সেপ্টেম্বরে আরও দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।”

এখন দৃষ্টি যাবে যুক্তরাজ্য ও সম্ভবত জার্মানির দিকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যেটি ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, ট্রাম্প না থাকলেও, এমন কোনো স্বীকৃতি দেবে বলে মনে হয় না।

এতকিছুর পরেও যাঁরা গাজার মাটিতে আছেন, তাঁদের জীবনে এই স্বীকৃতিতে কোনো বদল আসবে না।

হামাস একে বলেছে “একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।” ইসরায়েলি নেতারা বলেছে, এটি সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিরোধী, বললেন যে এটি “সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করছে।” ইসরায়েলের ডানপন্থী নেতারা আরও একধাপ এগিয়ে বলছেন, এই স্বীকৃতি এখন পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করার যৌক্তিকতা তৈরি করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রও এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মার্কো রুবিও, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব, বললেন, “আমরা এই সিদ্ধান্তকে শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।” তিনি আরও লিখেছেন, “এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত হামাসের প্রচারণায় সাহায্য করবে এবং শান্তিপ্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটি ৭ অক্টোবরের নিহতদের প্রতি এক ধরনের চপেটাঘাত।”

তবে গাজায় খাদ্য অবরোধের মধ্যে যারা প্রতিদিন না খেয়ে মরছে, তাদের জন্য এই স্বীকৃতি হয়তো অনেক দেরিতে আসবে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা UNRWA’র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বললেন, গাজার মানুষ যেন এখন “হাঁটতে হাঁটতে মরে যাচ্ছে।”

২১ লাখ মানুষের কেউই এখন খাদ্য নিরাপত্তায় নেই। মঙ্গলবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ৯ লাখ শিশু না খেয়ে আছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

মাক্রোঁর একক ঘোষণায় অনেকেই দেখছেন একরকম হতাশা।

তিনি সাধারণত আন্তর্জাতিক মঞ্চে জোট তৈরি করতে পছন্দ করেন। অনেককে নিয়ে একসাথে চলতে ভালোবাসেন। এক মাস আগে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ আয়োজনে রিয়াদে একটি সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছিল ১৭ থেকে ২০ জুন। কিন্তু ১৩ জুন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেছিলেন, ফ্রান্স ও সৌদি আরব একত্রে অন্য দেশগুলোকেও পাশে টেনে আনবে এবং সম্মিলিতভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।

এখন মাক্রোঁ হয়তো সেপ্টেম্বরে কিছু মিত্রকে নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে জোরদার করতে পারবেন। তবে এ যাত্রা সহজ হয়নি। তিনি নিজেই আরও কিছু অনিচ্ছুক মিত্রকে চাপ দিয়ে পাশে আনতে চাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্টের সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

ইউরোপীয় দেশগুলো সাধারণত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধায় পড়ে। ইসরায়েলের প্রতি শ্রদ্ধা, গাজায় ইসলামপন্থী শাসনের প্রতি অনিচ্ছা, ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে এতদিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে কথাবার্তা হলেও তা বাস্তব হয়নি।

এখন ফ্রান্স সেই অনিচ্ছার দেয়াল ভেঙে ফেলল।

ফ্রান্সের ভেতরে ফিলিস্তিনি বিষয়কে ঘিরে সহানুভূতি বরাবরই ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফ্রান্স বহু বছর ধরে পিএলও-র সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে, এমনকি যখন পিএলও’র নামে ফরাসি মাটিতে হামলা হয়েছে তখনও।

২০১৪ সালে ফরাসি সংসদ সরকারকে আহ্বান জানায় ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে। সরকার তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি তোলে, কিন্তু ব্যর্থ হয়।

ফ্রান্স ১৯৬৭ সালের সীমারেখা ধরে দুই রাষ্ট্র সমাধান চায় বহুদিন ধরেই। তবে ইলিসি প্রাসাদের সূত্র জানায়, এবারের স্বীকৃতিতে সীমারেখা নির্দিষ্ট করে বলা হবে না।

অক্টোবর ৭ এর হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াকে মাক্রোঁ প্রথমে সমর্থন করলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতানিয়াহুর নীতির সমালোচনা বাড়িয়েছেন।

তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, এই সংঘাত যেন ফ্রান্সে আমদানি না হয়। কারণ এখানে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইহুদি ও মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে।

তবে গাজায় মৃতের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্স ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করেছে, গাজায় ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে, এবং একাধিকবার যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকারের দাবি জানিয়েছে।

এই স্বীকৃতির মাধ্যমে হয়তো ইলিসি প্রাসাদ আশা করছে, পশ্চিমা দুনিয়ায় স্বীকৃতির এক ধরনের ডোমিনো প্রক্রিয়া শুরু হবে।

যেখানে এখনো সাধারণ গাজাবাসীর কাছে সাহায্য পৌঁছায় না, সেখানে এই স্বীকৃতি হয়তো শেষ চেষ্টা—একটু হলেও কষ্ট লাঘবের আশায়।

সূত্র: সিএনএন

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন