Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ভারতের এক তীর্থনগরী কীভাবে শত শত হত্যার অভিযোগের কেন্দ্রে এসে দাঁড়াল

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ০২:০৩ পিএম

ভারতের এক তীর্থনগরী কীভাবে শত শত হত্যার অভিযোগের কেন্দ্রে এসে দাঁড়াল

ধর্মস্থান মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একদল তীর্থযাত্রী, যেখানে প্রতিদিনই শত শত মানুষ পূজায় অংশ নিতে আসে [ছবি: লুইস দাফোস / গেটি ইমেজেস]

তিন দশক ধরে ভয়, অপরাধবোধ আর নির্ঘুম রাতের ভেতর পালিয়ে বেড়ানোর পর কর্ণাটকের এক ব্যক্তি সামনে এসে এমন এক ভয়াবহ ঘটনা জানিয়েছেন, যা ভারতের অন্যতম আলোচিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বয়স এখন ৪৮। তিনি একজন দলিত, অর্থাৎ ভারতের সবচেয়ে নিচু জাতিভুক্ত মানুষ। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানিয়েছেন, তিনি আগে ধর্মস্থান মন্দিরে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। গত ৩ জুলাই তিনি পুলিশের কাছে এসে জানান, বহু বছর ধরে তার ওপর চাপ ছিল নীরব থাকার। এবার আর পারেন না। তিনি বলেছেন, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না সেই লাশগুলো মনে করা, আমাকে বলা হয়েছিল যদি আমি না কবর দিই, তবে আমাকেও ওদের সঙ্গে কবর দেওয়া হবে।”

এই মানুষটি ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে বহু নারীর মৃতদেহ কবর দিয়েছেন বলে জানান। অনেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি আরও জানান, গরিব ও পরিচয়হীন পুরুষদেরও হত্যা করে কবর দেওয়া হয়েছে, যা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন।

এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর কর্ণাটক সরকার—যা বর্তমানে কংগ্রেস পরিচালিত—একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছে। সামাজিক চাপ এবং বিভিন্ন পক্ষের দাবি ওঠার পর এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

এই ব্যক্তি বলেন, ১৯৯৫ সালে তিনি যখন ধর্মস্থান মন্দিরে কাজ শুরু করেন, তখন থেকেই নদীর পাড়ে লাশ পড়তে দেখেন। অনেক নারী লাশের গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। শরীরে আঘাতের চিহ্ন, যৌন নির্যাতনের স্পষ্ট প্রমাণ ছিল। তিনি দাবি করেন, তাকে মারধর করে বলা হতো, লাশ গায়েব না করলে তার পরিবারকেও হত্যা করা হবে।

তিনি বলেন, অনেক সময় তাকে কম বয়সী মেয়েদের লাশ কবর দিতে বলা হতো। তাদের গায়ে জামা থাকলেও অন্তর্বাস বা স্কার্ট থাকত না। কোথাও কোথাও অ্যাসিডে পোড়ানোর চিহ্ন ছিল। কোথাও আবার তাকে লাশ পুড়িয়ে ফেলতে বলা হতো, যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে। তার ভাষায়, “এভাবে আমি শত শত লাশ মাটি বা আগুনে ফেলে দিয়েছি।”

২০১৪ সালের দিকে এক আত্মীয় কন্যার সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতনের ঘটনায় পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর ১২ বছর গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। কিন্তু দোষী অপরাধীদের বিচার না দেখে তার আত্মা শান্তি পাচ্ছিল না।

সম্প্রতি এক কবরস্থানে গিয়ে তিনি একটি কঙ্কাল খুঁড়ে তুলে আনেন। এর ছবি ও প্রমাণ তিনি আদালতে জমা দেন। তার আইনজীবীর মাধ্যমে পুলিশকেও দেন। এখন তিনি ব্রেন ম্যাপিং, পলিগ্রাফ টেস্টসহ যেকোনো পরীক্ষায় রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি একবার বলেন, ২০১০ সালে একটি কিশোরীর লাশ তাকে কবর দিতে বলা হয়। মেয়েটির বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ বছর। গায়ে ছিল স্কুল শার্ট, কিন্তু স্কার্ট বা অন্তর্বাস ছিল না। গলায় ছিল দম বন্ধের দাগ। তার সঙ্গে ব্যাগটিও কবর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আরেকটি ঘটনায় তিনি বলেন, একজন যুবতীর মুখ অ্যাসিডে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাকে খবরের কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে বলা হয় ওই মহিলার চপ্পল ও অন্যান্য জিনিস পুড়িয়ে ফেলতে।

এই ধর্মস্থান এলাকায় আগেও এরকম অভিযোগ এসেছে। ১৯৮৭ সালে ১৭ বছরের পদ্মলতা নামের এক মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বড় আন্দোলন হয়। ২০১২ সালে ১৭ বছরের সৌজান্যাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটলে আবার আন্দোলন শুরু হয়। সেই মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

ধর্মস্থান মন্দির পরিচালনা করে হেগগাড়ে পরিবার। বীরেন্দ্র হেগগাড়ে ১৯৬৮ সাল থেকে এই মন্দিরের প্রধান। তিনি পদ্ম বিভূষণপ্রাপ্ত এবং বিজেপি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য।

২০১২ সালে সৌজান্যার মৃত্যুর পর মন্দির কর্তৃপক্ষ জনরোষের মুখে পড়ে। তার পরিবার আজও দাবি করে, অপরাধীরা মন্দিরের সঙ্গে জড়িত।

এখন মন্দির কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা স্বচ্ছ তদন্ত চায় এবং রাজ্য সরকার যে বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছে, সেটি যেন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। শ্রী ক্ষেত্র ধর্মস্থান মন্দিরের মুখপাত্র কে পারশ্বনাথ জৈন বলেন, অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে, এবং মন্দির কর্তৃপক্ষ চায় সত্য উদঘাটিত হোক।

এদিকে নিখোঁজদের পরিবারগুলোও মুখ খুলতে শুরু করেছে। ২০০৩ সালে নিখোঁজ হওয়া অনন্যা ভাটের মা সুযাতা ভাট সম্প্রতি পুলিশের কাছে নতুন অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সিবিআই টাইপিস্ট। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ভয়ে ছিলেন, কিন্তু এখন মাটির নিচে কঙ্কাল খুঁড়ে বের করে এনে আবার কবর দিতে পারেন না। তিনি চান, মেয়ের হাড়গোড় যেন ফিরে পান এবং সম্মানের সঙ্গে সৎকার করতে পারেন।

তার কথায়, “আমি শুধু চাই, আমার মেয়ের আত্মা যেন শান্তি পায়। আমি যেন বাকি জীবনটা একটু শান্তিতে কাটাতে পারি।”

সূত্র: আল জাজিরা

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন