Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

মিডল ইস্ট আইয়ের মতামত প্রতিবেদন

গাজায় হত্যাযজ্ঞ: ক্ষুধায় মরার আগে মানুষের শেষ ভাবনা কী হয়?

Icon

মাহা হুসেইনি

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১১:০৮ এএম

গাজায় হত্যাযজ্ঞ: ক্ষুধায় মরার আগে মানুষের শেষ ভাবনা কী হয়?

একজন ১৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি কিশোর, যার পরিবার জানায় সে অপুষ্টিতে ভুগছে, তাকে কোলে তুলে রেখেছেন তার বাবা — গাজার বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে, ১২ এপ্রিল ২০২৫ (ছবি: এএফপি)

গাজায় ক্ষুধায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শিশুরা। শুধু গত রোববারেই না খেয়ে অন্তত ১৮ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ১৫ জন মারা যাচ্ছে। ইসরায়েল যে ভাবে পরিকল্পিতভাবে গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষের খাদ্য রুদ্ধ করে রেখেছে, এটা যেন এক নীরব নিধনযজ্ঞ।

প্রতিবার নতুন একটা মৃত্যুর খবর আসলেই মনে প্রশ্ন জাগে—একজন মানুষ যখন না খেয়ে মারা যায়, তখন তার মাথায় কী চিন্তা ঘুরতে থাকে? আমি নিজে বারবার চেষ্টা করি এসব থেকে মন সরিয়ে নিতে। কিন্তু ফোনের পর্দায় ভেসে ওঠে আরেকটা নাম, আরেকটা মৃত্যু। আবার ফিরে যাই সেই চক্রে—একটাই ভাবনা, শেষ মুহূর্তে তারা কী ভেবেছিল?

বিমান হামলার সময় কী ভাবি আমরা, সেটা অনেকেই জানে গাজায়। ওই চিন্তা এত বেশি মনে গেঁথে গেছে যে, মনে হয় শরীরের স্নায়ুতেই বসে গেছে। এই যুদ্ধ শেষ হলেও ওই ভয় হয়তো কোনোদিন যাবে না।

চিকিৎসা না পেয়ে যারা মারা গেছে, তাদের মুখের দিকে আমি নিজ চোখে তাকিয়ে থেকেছি। মৃত্যুর সময় তাদের চোখে যে হাহাকার থাকে, সেটা বোঝা যায়। কী ভেবেছিল তারা, তা প্রায় শুনতে পাই মনে।

কিন্তু ক্ষুধার মৃত্যু ভিন্ন। আমি ভাবি, কেউ বিছানায় পড়ে আছে, একা, চারদিকে নিঃস্তব্ধতা—এমন এক নিঃশব্দ যা হাড়-মাংস-রক্ত সবকিছু থামিয়ে দিতে পারে। এই নীরবতা যেন সেই ১ লাখ ২৫ হাজার টন বোমার চেয়েও ভয়ংকর, যা গত ২১ মাসে গাজার ওপর ফেলা হয়েছে। এই নিঃশব্দতা বন্ধ করে রেখেছে সীমান্ত, আটকে দিয়েছে খাবার।

এত কিছু বেঁচে থেকেও, এক বাটি ভাত না পেয়ে মারা যেতে হচ্ছে মানুষকে। হাজারো বোমা, গুলি, মহামারী, হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে যারা কোনোভাবে টিকে ছিল, তাদের কি মনে হয় না, এই মৃত্যুটা অন্যায়? তারা কি ভাবে—এই মানবসভ্যতা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?

হয়তো তারা শুধু খাবারের কথা ভাবে। শেষবার খাওয়া কোনটা ছিল, সেই স্বাদ মনে পড়ে কি? পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া, গরম হাড়ির ভাপে ওঠা গন্ধ, চামচের শব্দ—এসব কি তাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে?

হয়তো ক্ষুধার্ত মস্তিষ্ক তাদের প্রতারণা করে, বলে—তুমি পেট ভরে খেয়েছো। কিংবা হয়তো এক ফোঁটাও খাবার না পেয়েও তারা মনে করে, এই প্রথমবার অন্তত আত্মা ভরে গেছে। সম্মানের শেষ কিছুটুকু হারানোর আগে তারা হয়তো ভাবে—এই লড়াইটা বোধহয় বৃথা ছিল। এই পৃথিবী তাদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার যোগ্য না। এই মৃত্যুই হয়তো তাদের শেষ মুক্তি।

আজ গাজার ট্যাক্সি রাইডগুলো এসব গল্পে ভরা। সমাজ কেমন আছে, সেটা বোঝা যায় এখানকার ট্যাক্সিতে। কেউ উঠলেই শুরু হয় কথা—খাবারের দাম, গরমের যন্ত্রণা, আর চালকের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।

যখন আমার গাড়ি ছিল, তখনো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ট্যাক্সি ধরতাম, এই কথাগুলো শুনতে।

গত সপ্তাহে কাজে যাওয়ার পথে এক মা ও তার নবজাতক সন্তানকে নিয়ে আমি এক ট্যাক্সিতে উঠলাম। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে শিশুটি তার মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছিল। আমি বললাম, "বাচ্চাটা মনে হয় গরমে খুব কষ্ট পাচ্ছে।"

মা বললেন, “না, ঘুম পাচ্ছে ওর। রাতে ঠিকমতো ঘুমায়নি।”

জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

উত্তরে বললেন, “দুধ পায় না। এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

তিনি জানান, তার শিশুটি মাত্র এক মাস বয়সী, এবং মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। জন্মের পর ওজন ছিল ৩.৮ কেজি, এখন কমে ৩.৩ কেজি হয়ে গেছে। মায়ের নিজের শরীরেই পুষ্টি নেই, তাই দুধেও প্রয়োজনীয় উপাদান নেই। শিশু ফর্মুলা তো এখন বিলাসিতা, কোনোখানেই পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও কয়েক সপ্তাহ আগেও এক নারী ও তার মেয়ের সঙ্গে রাইড শেয়ার করেছিলাম। শিশুটি খেলতে খেলতে আমার ব্যাগে হাত দিচ্ছিল। আমি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আল্লাহ হেফাজত করুন, বয়স কত?"

মা বললেন, “পাঁচ।”

আমি জানি, পাঁচ বছর বয়সী শিশুর হাত এমন হাড়সর্বস্ব হওয়ার কথা নয়। ওর হাত এমন যেন তিন বছরের শিশুর মতো।

আমি ভুলে গেছি ঠিক কতজন মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার, যারা হাসপাতালে ছুটছেন অপুষ্ট সন্তানদের নিয়ে। চোখ বসে যাওয়া, মুখে চামড়ার মতো টান পড়া, ক্ষুধায় ভেঙে পড়া ছোট ছোট মুখগুলো দেখে বারবার মনে হয়—এই জাতি নিশ্চুপে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

তবে শুধু ট্যাক্সি নয়। ফার্মেসিগুলোতেও ওষুধ নেই, হাসপাতালে সরঞ্জাম নেই, বাজারে খাবার নেই। আর বাড়িতে আছে ক্ষুধার্ত শিশুরা, যারা প্রতিদিন খালি পেটে ঘুমাতে যাচ্ছে।

গাজার ট্যাক্সি আসলে জানালার মতো—একটা সমাজ কীভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, তার নিঃশব্দ দলিল।

মাহা হুসেইনি গাজাভিত্তিক একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান কাভার করার মধ্য দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। মানবিক সংকট ও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নির্ভীকভাবে প্রতিবেদন করার জন্য তিনি ২০২০ সালে সম্মানজনক **মার্টিন অ্যাডলার পুরস্কার** অর্জন করেন। মাহা একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গাজা সংকটের মানবিক দিকটি তুলে ধরার জন্য পরিচিত।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন