Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

‘মানবিক শহর’ আসলে ফিলিস্তিনিদের জন্য এক ধরনের বন্দিশিবির : ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৭ এএম

‘মানবিক শহর’ আসলে ফিলিস্তিনিদের জন্য এক ধরনের বন্দিশিবির : ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী

এহুদ ওলমার্ট বলেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যেই গাজা ও পশ্চিম তীরে যুদ্ধাপরাধ করছে, আর ওই শিবির নির্মাণ করা হলে তা হবে এক নতুন মাত্রার অপরাধের সূচনা।

ইসরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, রাফার ধ্বংসস্তূপে যে “মানবিক শহর” নির্মাণের পরিকল্পনা দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী করছেন, সেটি আসলে একটি ঘনিবাসন শিবির হবে এবং সেখানে ফিলিস্তিনিদের জোর করে প্রবেশ করানো হলে তা জাতিগত নির্মূলের শামিল হবে। তিনি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যেই গাজা ও পশ্চিম তীরে যুদ্ধাপরাধ করছে এবং এই শিবির নির্মাণ হলে তা এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ যে পরিকল্পনার কথা বলেন, সে বিষয়ে ওলমার্ট বলেন, “এটি একটি ঘনিবাসন শিবির, আমি দুঃখিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিরা একবার সেখানে ঢুকলে তারা আর বের হতে পারবে না, শুধু অন্য দেশে যেতে পারবে।”

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ গাজার ধ্বংসস্তূপে একটি “মানবিক শহর” নির্মাণের জন্য, যেখানে শুরুতে ৬ লক্ষ মানুষ ও পরবর্তীতে পুরো গাজার জনগণকে রাখা হবে। ওলমার্ট বলেন, যদি এই শহরে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর করা হয়, তবে সেটি জাতিগত নির্মূলের স্পষ্ট লক্ষণ হবে। যদিও তিনি বলেন, এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ওলমার্ট মনে করেন না যে বর্তমান অভিযানটি জাতিগত নির্মূল, কারণ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে লড়াই থেকে বাঁচাতে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া বৈধ। তিনি দাবি করেন, ফিলিস্তিনিরা অনেক এলাকায় ফিরে এসেছেন যেখানে যুদ্ধ শেষ হয়েছে।

এই প্রকল্পকে সমর্থন করছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু যেই এলাকায় শিবির নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, সেই স্থান থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্ত্রবিরতির আলোচনায়।

ওলমার্ট বলেন, গাজা পরিষ্কারের আহ্বান ও সেখানকার ভূমিতে ইসরায়েলি বসতি গঠনের পরিকল্পনা শুনে এই মানবিক শহর প্রকল্পের দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়। “যখন তারা একটি শিবির নির্মাণ করতে চায় যেখানে গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষকে ‘পরিষ্কার’ করা হবে, তখন স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে এটি রক্ষার জন্য নয়, বরং তাদের সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা। আমি এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেখি না।”

ইসরায়েলের মানবাধিকার আইনজীবী ও গবেষকরা এই পরিকল্পনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের রূপরেখা বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গণহত্যার শামিল হতে পারে।

যারা এই পরিকল্পনাকে নাৎসি জার্মানির ঘনিবাসন শিবিরের সাথে তুলনা করেছেন, তাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। ইসরায়েলের হলোকাস্ট স্মৃতিসৌধ ইয়াদ ভাসেম এমন এক সাংবাদিককে অভিযুক্ত করেছে “হলোকাস্টের অর্থের গুরুতর বিকৃতি” করার জন্য।

ওলমার্ট যেদিন সাক্ষাৎকার দেন, সেদিনই পশ্চিম তীরে দুই ফিলিস্তিনির জানাজা হয়, যাদের একজন আমেরিকান নাগরিক। তাদেরকে ইসরায়েলি বসতির লোকজন হত্যা করে। এই হত্যাগুলি যুদ্ধাপরাধ, বলেন ওলমার্ট। তিনি বলেন, “এটা অমার্জনীয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সংগঠিত ও নির্মম সহিংসতা, যা অনেক বড় একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।”

এই হামলাকারীদের ইসরায়েলে সাধারণত “হিলটপ ইয়ুথ” বলা হয়। ওলমার্ট বলেন, আমি এদের “হিলটপ আতঙ্ক” বলি। এরা বহুদিন ধরে সহিংসতা চালাচ্ছে, প্রশাসনের মদদ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

ওলমার্ট আরও বলেন, গাজা ও পশ্চিম তীরে যেসব চরমপন্থী মন্ত্রী সহিংসতাকে সমর্থন করেন এবং নতুন বসতি অনুমোদন দেন, তারা ইসরায়েলের ভবিষ্যতের জন্য বাইরের শত্রুর চেয়েও বেশি হুমকি। “এরা দেশের ভেতরের শত্রু।”

তিনি বলেন, গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এবং পশ্চিম তীরে বসতির সহিংসতার কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষোভ বাড়ছে, যা শুধু ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে ব্যাখ্যা করা ভুল হবে। “আমেরিকায় ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দেই যে তারা ইহুদিবিদ্বেষী। কিন্তু অনেকেই কেবল ইসরায়েলবিরোধী, কারণ তারা যেসব দৃশ্য দেখছে টেলিভিশনে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়, তা সহ্য করতে পারছে না।”

ওলমার্ট মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপ যতক্ষণ না ইসরায়েলিদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে, ততক্ষণ অভ্যন্তরীণ মনোভাব পরিবর্তন হবে না। তিনি দেশটির মিডিয়াকেও দোষারোপ করেন যে, তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার খবর প্রচার করছে না।

তিনি বলেন, ৭ অক্টোবর হামলার পর হামাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযানকে তিনি সমর্থন করলেও, এ বছরের বসন্তে যখন সরকার স্থায়ী শান্তি আলোচনার পথ ছেড়ে দেয়, তখন তিনি নিশ্চিত হন যে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করছে।

তিনি বলেন, “লজ্জিত ও হৃদয়বিদারক মন নিয়ে” তিনি উপলব্ধি করেন, আত্মরক্ষার যুদ্ধ এখন অন্য কিছুতে পরিণত হয়েছে। “আমার দায়িত্ব যে আমি এই অন্যায় স্বীকার করি, সমালোচনা করি, এবং আন্তর্জাতিক সমাজকে জানাই যে ইসরায়েলের ভেতরেও অনেক ভিন্ন মত রয়েছে।”

এই অপরাধগুলোকে তিনি পরিকল্পিত না হলেও, ভয়াবহ অবহেলা হিসেবে দেখছেন। তার মতে, সামরিক বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ রেখেছে, ফলে অনেক নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে। “আমি এই সরকারকে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী না করে পারছি না।”

তবু তিনি বিশ্বাস করেন, এখনও দুটি রাষ্ট্র গঠনের সমাধান সম্ভব। তিনি ফিলিস্তিনের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের আল-কিদওয়াহর সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে এই সমাধান প্রচারে কাজ করছেন। তার মতে, গাজার যুদ্ধের অবসান ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হলে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্ভব, যদি নেতানিয়াহু চান।

কিন্তু ওলমার্ট হতবাক হয়ে দেখেছেন, যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বারা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত, সেই নেতানিয়াহু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন।


দ্য গার্ডিয়ান

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন