আধুনিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে ট্রাম্পের আফ্রিকান সম্মেলন ছিল এক নির্মম পাঠ

তাফি মহাকা
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১১:২৭ এএম

সেনেগালের প্রেসিডেন্ট বাসিরু দিয়োমায় ফায়ে, গিনি বিসাউয়ের প্রেসিডেন্ট উমারো সিসোকো, মৌরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওলদ গাজোয়ানি, লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোআকাই এবং গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ব্রাইস ওলিগুই এনগেমা—ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের স্টেট ডাইনিং রুমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে অংশ নিচ্ছেন, ৯ জুলাই ২০২৫ \[কেভিন লামার্ক/রয়টার্স]
২০২৫ সালের ৯ জুলাই হোয়াইট হাউজে গ্যাবন, গিনি বিসাউ, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের নেতাদের নিয়ে তিন দিনের এক ছোট বৈঠকের সূচনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুরু থেকেই এই বৈঠক সম্মানজনক নয়, বরং যেন ছিল অপমানের মঞ্চ। শুরুতে বলা হয়েছিল, আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু একই দিন যুক্তরাষ্ট্র আরও আটটি দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করে, যার মধ্যে ছিল লিবিয়া ও আলজেরিয়ার মতো আফ্রিকান দেশও। একদিকে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা, আরেকদিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা—এই বৈপরীত্য ট্রাম্পের আফ্রিকা নীতির অসঙ্গতি বা প্রকৃত রূপ প্রকাশ করে।
ট্রাম্প তার চার মিনিটের বক্তব্যে বলেন, এই পাঁচ নেতা পুরো আফ্রিকা মহাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি তাদের ভূখণ্ডে থাকা খনিজ, তেল ও সম্পদের প্রশংসা করেন। এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, আফ্রিকাকে তিনি দেখেন একটুকরো জমি হিসেবে—যার মূল্য সম্পদে, মানুষের মর্যাদায় নয়। তিনি জানান, ‘আমরা এখন সাহায্য নয়, বাণিজ্য চাই।’ কিন্তু আলোচনার আসল চেহারা উন্মোচিত হয় যখন দেখা যায়, এটি কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নয়, বরং একতরফা শো—যেখানে ট্রাম্প ছিলেন পরিচালক, আর আফ্রিকান নেতারা পারফর্মার।
মৌরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট গাজোয়ানির বক্তব্য ছিল সবচেয়ে বিতর্কিত। তিনি ট্রাম্পকে বলেন ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শান্তিদূত’ এবং দাবি করেন, তিনি নাকি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ থামিয়েছেন। এই বক্তব্য ছিল বিভ্রান্তিকর ও বাস্তবতা-বিবর্জিত, কারণ একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের গাজা আক্রমণে সরাসরি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে—যা আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রকাশ্যে নিন্দা করেছে। গাজোয়ানির এমন মন্তব্য ছিল আসলে মার্কিন অনুগ্রহ পাওয়ার চেষ্টা, যেখানে নিজের দেশের সম্পদ পর্যন্ত তুলে দিতে প্রস্তুত।
এক পর্যায়ে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ফায়ে ট্রাম্পকে তার দেশে গলফ কোর্স বানাতে বলেন। জবাবে ট্রাম্প শুধু বলেন, ফায়ে দেখতে তরুণ। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোআকাই যখন ইংরেজিতে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, ট্রাম্প তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ইংরেজি এত ভালো শিখলে কোথায়? লাইবেরিয়াতে?’ তিনি যেন জানতেনই না, ইংরেজি লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রভাষা। বোআকাই বা সাংবাদিক হারিয়ানা ভেরাস—যাকে ট্রাম্প বলেছিলেন, “তুমি সুন্দর”—এগুলো ছিল ট্রাম্পের পক্ষপাতদুষ্ট ও অবমাননাকর মন্তব্য, যা প্রমাণ করে তার ভেতরে উপনিবেশিক মানসিকতা এখনো জীবিত।
এই বৈঠকে প্রকৃত কোনো সহযোগিতা হয়নি। বরং এটি ছিল এক ধরণের উপনিবেশিক থিয়েটার, যেখানে আফ্রিকান নেতারা নিজেদের স্বার্থে মাথা নত করলেন, আর ট্রাম্প নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। অথচ, কয়েক বছর আগেই বাইডেন প্রশাসনের আয়োজিত ইউএস-আফ্রিকা সম্মেলনে ৪০টিরও বেশি আফ্রিকান দেশ অংশ নিয়েছিল, যেখানে আলোচনায় ছিল আফ্রিকান ইউনিয়নের লক্ষ্য, নাগরিক সমাজ, ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
এই বৈঠকের মাধ্যমে স্পষ্ট হলো, ট্রাম্প কোনো আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি। তিনি চেয়েছিলেন প্রদর্শন—একটি দৃশ্য যেখানে আফ্রিকান নেতারা মাথা নিচু করে থাকবেন, আর তিনি ঘোষণা দেবেন, “এরা এখন আমার বন্ধু, তাই শুল্ক ছাড় দিলাম।” এটি ছিল আধুনিক বিশ্বে প্রাচীন ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিফলন। [আল জাজিরা থেকে]
তাফি মহাকা একজন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন।