Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

গাজার জনবহুল এলাকায় ৫০০ পাউন্ডের বোমা ফেলল ইসরায়েল

যুদ্ধাপরাধ

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১০:৪১ এএম

গাজার জনবহুল এলাকায় ৫০০ পাউন্ডের বোমা ফেলল ইসরায়েল

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সোমবার গাজার এক সমুদ্রতীরবর্তী ক্যাফেতে যে বিমান হামলা চালায় সেখানে ৫০০ পাউন্ড বা ২৩০ কেজি ওজনের একটি শক্তিশালী বোমা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রকাশিত প্রতিবেদনে ধ্বংসস্তূপে পাওয়া বোমার টুকরো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি একটি এমকে-৮২ মার্কিন-নির্মিত জেনারেল পারপাস বোমা ছিল। এই ধরনের বোমা বিস্ফোরণের ফলে ব্যাপক এলাকা জুড়ে চাপের তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং বোমার ধাতব অংশ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন এমন জায়গায় যেখানে অরক্ষিত বেসামরিক মানুষের উপস্থিতি স্পষ্ট, বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রবীণদের থাকা জানা ছিল, সেখানে এই ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার প্রায় নিশ্চিতভাবেই অবৈধ এবং এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

দ্য গার্ডিয়ান যে ছবিগুলো প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত আল-বাকা ক্যাফের মাটিতে বড় একটি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে যা এমন ধরনের ভারী বোমার ব্যবহারেরই ইঙ্গিত দেয়। দুটি বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন এই গর্তের আকার বলছে এটি ছিল খুব শক্তিশালী বিস্ফোরণ। সেই গর্ত এবং ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগ্রহ করা ধাতব খণ্ড দেখে তাঁরা নিশ্চিত করেছেন এটি একটি এমকে-৮২ বোমার অংশ।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন ক্যাফেতে আক্রমণের ঘটনাটি তদন্তাধীন। তিনি দাবি করেছেন হামলার আগে বেসামরিক মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য আকাশপথে নজরদারি চালানো হয়েছিল।

চিকিৎসা কর্মকর্তারা বলছেন এই হামলায় অন্তত ২৪ থেকে ৩৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন একজন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, একজন শিল্পী, ৩৫ বছর বয়সী গৃহবধূ এবং চার বছর বয়সী একটি শিশু। আহতদের মধ্যে ছিলেন ১৪ বছরের একটি ছেলে এবং ১২ বছরের একটি মেয়ে।

আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, সামরিক লাভের তুলনায় অতিরিক্ত সংখ্যক বেসামরিক মানুষের জীবনহানি ঘটানো হলে সেটিকে অবৈধ হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন একটি হামলার লক্ষ্য যদি এমন কিছু না হয় যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তাহলে সেখানে এত বেসামরিক মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না।

আল-বাকা ক্যাফেটি ছিল দুই তলার একটি কাঠামো। ওপরে ছিল উন্মুক্ত ছাদ আর নিচে ছিল বড় বড় জানালা যা সমুদ্রের দিকে খোলা ছিল। উপর থেকে এই ক্যাফে খুব সহজেই দেখা যায়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গেরি সিম্পসন বলেছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়নি তারা কাকে লক্ষ্য করে হামলা করেছিল কিন্তু তারা বলেছে নজরদারির মাধ্যমে বেসামরিক মৃত্যুর ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা জানত ক্যাফেটি তখন মানুষে পূর্ণ ছিল। এই অবস্থায় একটি বড় বিস্ফোরক বোমা ব্যবহারের ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হতে পারে তা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। এমন হামলা অসঙ্গতিপূর্ণ এবং নির্বিচারে চালানো হয়েছে, এটিকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করা উচিত।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক ডঃ অ্যান্ড্রু ফোর্ড বলেছেন এই হামলা ছিল ভয়ানক। তিনি বলেন জনবহুল বেসামরিক স্থানে এমন ভারী অস্ত্র ব্যবহার করলেই নিঃসন্দেহে ফলাফল হবে নির্বিচার এবং এটি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আইন বহির্ভূত।

প্রায় ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই পরিবার পরিচালিত আল-বাকা ক্যাফে গাজার তরুণ এবং পরিবারগুলোর জন্য একটি জনপ্রিয় বিনোদনস্থল ছিল। এখানে সাধারণত চা, বিস্কুট আর নরম পানীয় পরিবেশন করা হতো।

গাজার ২৩ লাখ মানুষ প্রচণ্ড খাদ্য সংকটের মধ্যে থাকলেও কেউ কেউ সঞ্চয় বা বেতনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা সামান্য বিনোদন খোঁজার চেষ্টা করেন। সেই প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ক্যাফে একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করত।

এই ক্যাফের আশেপাশের বন্দরের এলাকাটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জারি করা কোনো সর্তকীকরণ বা স্থানত্যাগ নির্দেশনার আওতায় ছিল না। অর্থাৎ সেখানে কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই হামলা চালানো হয়েছে।

কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে অধ্যাপক মার্ক শ্যাক বলেছেন এমন বোমা ব্যবহার করাকে ন্যায্যতা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি ২০ ৩০ বা তার বেশি বেসামরিক লোক মারা যায় তাহলে লক্ষ্যবস্তুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়। আফগানিস্তান বা ইরাকে জোট বাহিনীর নীতিতে বলা হয়েছিল যদি সর্বোচ্চ মানের লক্ষ্যবস্তু হয় তবেই বিশেষ পরিস্থিতিতে ৩০ জনের কম বেসামরিক প্রাণহানিকে মেনে নেওয়া যেতে পারে।

অস্ত্র গবেষক ও মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ বিশেষজ্ঞ ট্রেভর বল বলেন ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া একটি জেডড্যাম টেইল সেকশন ও থার্মাল ব্যাটারির ভিত্তিতে তিনি মনে করেন এটি এমপিআর৫০০ অথবা এমকে-৮২ বোমা ছিল।

অপর এক বিশেষজ্ঞ যিনি বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিনিও একই ধরনের বোমার কথা বলেছেন। তৃতীয় একজন বলেছেন শুধু ছবির ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

ইসরায়েলের হাতে অনেক ধরনের অস্ত্র আছে এবং তারা অতীতে গাজা লেবানন ও সম্প্রতি ইরানের উপর চালানো হামলায় একাধিকবার ছোট মাপের অস্ত্র ব্যবহার করেছে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করেও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। তারা বলেছে লক্ষ্যবস্তুর প্রকৃতি অনুযায়ী মারণাস্ত্র বেছে নেওয়া হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল কিছু লক্ষ্যবস্তুর ক্ষেত্রে হালকা অস্ত্র যথেষ্ট হলেও শক্ত দেয়ালবিশিষ্ট ভবন বা ভূগর্ভস্থ টানেল ধ্বংস করতে হলে ভারী অস্ত্র প্রয়োজন হয়।

মঙ্গলবার এক ইসরায়েলি সরকারি মুখপাত্র বলেছেন ইসরায়েলি বাহিনী কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু বানায় না।

ইসরায়েল বহুবার অভিযোগ করেছে হামাস বেসামরিক লোকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন