মধ্যপ্রাচ্যের খবর জেনারেশন জেডের মানসিক স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব ফেলছে

শেরউক জাকারিয়া
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:৪৫ এএম

জেনারেশন জেড যেকোনো ধরনের কনটেন্টের চেয়ে সংবাদ বেশি পড়ে — এমন তথ্য জানিয়েছে ইউনিসেফের নেতৃত্বে গঠিত গ্লোবাল কোয়ালিশন ফর ইয়ুথ মেন্টাল হেলথ।
এই তথ্য অনেকের কাছে আশ্চর্য লাগতে পারে। তবে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সংবাদের নেতিবাচক প্রভাব খুব একটা অবাক করার মতো নয়।
১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বিশ্বের ৫৬০০ জনের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ তরুণ মনে করে তারা সংবাদে অভিভূত হয়ে পড়ছে। তবু তারা ভবিষ্যৎকে ভালো করার জন্য নিজস্ব অবদান রাখতে চায়।
ইউনিসেফের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. যায়নাব হিজাজি আরব নিউজকে বলেন, এ ধরনের উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক সংঘাত, জলবায়ু বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সম্মিলিত প্রভাবে।
তিনি বলেন, "বিশেষ করে তরুণদের জন্য এসব সংকট কেবল ধারণার বিষয় নয় — তারা এটি শরীর, মন এবং ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্ক্ষায় অনুভব করে।"
এই গবেষণা তুলে ধরা হয়েছে সান ফ্রান্সিসকোর সোশ্যাল ইনোভেশন সামিটে। এতে বলা হয়, তরুণদের ক্ষমতায়নের অনুভূতি কমে যাওয়ায় তারা ভবিষ্যৎ গঠনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া তাদের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা ও পরিষেবার অভাব মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
হিজাজি বলেন, "এখন মনে হয় যেন আমরা সবসময় একটি ঝড়ের মধ্যে আটকে আছি, কিন্তু আমাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই।"
তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যকে যেন বিশ্বসংকটের এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা না হয় — বরং এটি হওয়া উচিত তরুণদের ক্ষমতায়নের মূল স্তম্ভ।
গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বের ৬৭ শতাংশ তরুণ আন্তর্জাতিক সংবাদ দেখে মানসিকভাবে অভিভূত হয়ে পড়ে।
এর চেয়ে কম — ৬০ শতাংশ জাতীয় সংবাদে এবং মাত্র ৪০ শতাংশ স্থানীয় সংবাদে একই রকম অনুভব করে।
২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সহিংসতা তরুণদের ওপর দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। এতে চরমপন্থার আশঙ্কাও বেড়েছে।
গাজার শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়েও আশঙ্কা বাড়ছে।
সংবাদ যদি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আসে, তাহলে মানসিক প্রভাব আরও বেশি হয় — বলছেন মনোবিদ ও মিডিয়া বিশ্লেষকরা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাইমা আল-ফারদান বলেন, ক্রমাগত খবর ও স্ক্রলিংয়ের কারণে তরুণরা বাস্তব জীবনের সামাজিক মেলামেশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এতে প্রয়োজনীয় সামাজিক দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না।
তবে এতে নেতিবাচক আবেগ আরও বাড়ে এবং তা দীর্ঘদিনে স্থায়ী হয়ে যায়।
ভোক্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাটেস্ট জানায়, সোশ্যাল মিডিয়া জেনারেশন জেডের প্রধান সংবাদ মাধ্যম।
৪৩ শতাংশ তরুণ প্রতিদিনের খবরের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করে। ২১ শতাংশ ব্যবহারকারী টিকটক ব্যবহার করে খবর পায়।
ডা. ফারদান বলেন, এতে বিশ্বজুড়ে তরুণদের সচেতনতা বাড়ে ঠিকই, তবে ভুল তথ্য ও প্রোপাগান্ডার ঝুঁকিও বাড়ে।
তরুণদের মস্তিষ্ক তখনও পরিপূর্ণভাবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তৈরি হয় না — এজন্য খবর বিশ্লেষণের দক্ষতা শেখানো জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
তবে তিনি আরও বলেন, তরুণরা প্রথমে শক্ত প্রতিক্রিয়া দিলেও দ্রুত বিরক্ত বা উদাসীন হয়ে পড়ে।
"সোশ্যাল মিডিয়া একটি ট্রেন্ড ভিত্তিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তাই প্রতিক্রিয়া টেকসই হয় না," — বলেন তিনি।
সংক্ষিপ্ত ও দ্রুতগামী কনটেন্ট তরুণদের আবেগপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ইন দ্য এমিরেটসের গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক এলিজাবেথ মাতার বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া তথ্যের পরিমাণ বাড়ালেও বিশ্লেষণ বা গভীরতা বাড়ায়নি।
তাঁর মতে, কেবল হেডলাইন আর ছবি দেখে তরুণরা ঘটনার পূর্ণ মাত্রা বোঝে না। এতে তাদের বিচারক্ষমতা তৈরি হয় না।
তিনি বলেন, "তথ্যের বন্যা চলছে — কিন্তু বোঝার অভাব রয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।"
মনোবিদদের মতে, তরুণদের অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হলেও এখনও সহায়তা নিতে সংকোচ বোধ করে।
৪০ শতাংশ জানায়, স্কুল বা কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে তারা সংকোচ বোধ করে।
শুধু ৫০ শতাংশ জানে, কোথায় সহায়তা পাওয়া যায়।
ডা. আল-ফারদান বলেন, অনেক সময় ব্যয়বহুল চিকিৎসা, ইনস্যুরেন্সের অভাব এবং দক্ষ থেরাপিস্টের সংকট একটি বড় বাধা।
এছাড়া অনেক তরুণ রাজনৈতিক বিষয়ে নিজ মত প্রকাশে ভয় পায় বা বিভ্রান্ত হয়।
তিনি বলেন, "অনিয়ন্ত্রিত স্ক্রলিং দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের চিন্তার ধারা বদলে দেয়, যা উদ্বেগ, বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়াতে পারে।"
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষাগত জ্ঞান, গণমাধ্যম সচেতনতা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সীমা নির্ধারণ এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরি জরুরি।
ডা. হিজাজি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, রাষ্ট্র, বিদ্যালয়, নিয়োগকর্তা ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত দায়িত্ব।
“শুধু তথ্য নয়, অনুভব শুনতে শিখলে তবেই আমরা কার্যকর সমাধান তৈরি করতে পারব।” [আরবনিউজ ডটকম থেকে]