প্রতিদিন ব্যয় শত শত মিলিয়ন ডলার
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতেই ফতুর হচ্ছে ইসরায়েল

ছবি: সংগৃহীত
পাল্টা হামলায় ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে প্রতিদিন শত শত মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে ইসরায়েলকে। আর এই ব্যয় ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ কতদিন চলবে তা নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিশেষজ্ঞদের বরাতে এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ইসরায়েল যেসব প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র (ইন্টারসেপ্টর মিসাইল) ব্যবহার করছে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এর পাশাপাশি বিস্ফোরক, যুদ্ধবিমান এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ—যাকে ‘নজিরবিহীন’ বলা হচ্ছে তাও যুদ্ধের মোট খরচ অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর বিপুল পরিমাণ ব্যয়ই ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান কতদিন চলবে তা নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
ব্যাংক অব ইসরায়েলের সাবেক গভর্নর ও ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট থিংক ট্যাঙ্কের জ্যেষ্ঠ ফেলো কারনিত ফ্লুগ বলেছেন, যুদ্ধের স্থায়িত্বকালই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে কত ব্যয় হবে তা নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখবে। স্থায়িত্বকাল যদি এক সপ্তাহ হয় তবে সেটি এক ব্যাপার। আর সেটি যদি দুই সপ্তাহ বা এক মাস হয় তবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যাপার।
গত ১৩ জুন তেল আবিব তেহরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এরপর পর থেকে চার শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান। আয়রন ডোম, ড্যাভিড’স স্লিং ও অ্যারো-৩ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে প্রতিদিন ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের যতগুলো পারছে ঠেকাচ্ছে ইসরায়েল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতেই ইসরায়েলের প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে।
তেল-আবিব ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়োশুয়া কালিস্কির হিসাব অনুযায়ী, ড্যাভিড’স স্লিং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতি সক্রিয় করতেই ব্যয় হয় প্রায় সাত লাখ মার্কিন ডলার। ধরা নেওয়া হচ্ছে, সর্বনিম্ন দুইটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই ব্যবহার করা হয়েছে।
কালিস্কি আরও জানান, অ্যারো-৩ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিবার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোতে ব্যয় হয় প্রায় চার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার প্রভাবও বেশ ব্যয়বহুল।
গত ১৪ জুন ইরানের ছোড়া কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব এবং হাইফার বিভিন্ন স্থানে আঘাত হেনেছে। লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল তেল আবিবের দক্ষিণে রেহোভোট শহরে অবস্থিত ওয়েইজম্যান বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, যাকে প্রায়শই ইসরায়েলের ম্যাচাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সমতুল্য বলা হয়। আরটির প্রকাশ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ইনস্টিটিউটের ভেতরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ইনস্টিটিউটির অনুমান, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে এর প্রধান গবেষণাগারের যে ক্ষতি হয়েছে তা প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রায় ৪০টি গবেষণাগার আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনটি প্রধান গবেষণা ভবন ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্য ভবনগুলোও আংশিক আক্রান্ত হয়।
এই সংখ্যাটি শুধু অবকাঠামোগত ক্ষতির হিসাব ধরে করা হয়েছে। এতে বৈজ্ঞানিক যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে তা ধরা হয়নি—যার মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্লভ উপাদান, অপরিবর্তনীয় নমুনা এবং বছরের পর বছর চলা অসমাপ্ত গবেষণা রয়েছে। প্রতি গবেষণাগার পুনর্নির্মাণের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে।
এদিকে, ১৩ জুনের পর থেকে ইরান প্রতিদিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে যাচ্ছে। এতে ভবনগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হচ্ছে বা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং হাজার হাজার ইসরায়েলি গৃহহীন হয়ে পড়ছে। ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে অন্ততপক্ষে ১৫ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলের কর কর্তৃপক্ষ বলেছে, সংঘাত শুরুর পর এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ তহবিল কল সেন্টার ক্ষতিগ্রস্তের ৯৯০০টি ফোন পেয়েছে। এর মধ্যে ৮৫৪৯টি ফোন ছিল অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত, ৬৬৮টি যানবাহন ক্ষয়ক্ষতির এবং ৬৮৩টি ছিল বিভিন্ন সামগ্রী ও অন্যান্য সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত।
শুধু ১৩ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির পরমিান আনুমানিক ২৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে।
ইসরায়েলে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিও দেশটির অর্থনীতির জন্য হুমকি তৈরি করছে। আজ শুক্রবার ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরানি হামলার ঝুঁকির কারণে শিপিং জায়ান্ট মারসক ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে যাত্রা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
গত ১৬ জুন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর দেশের সবচেয়ে বড় তেল শোধনাগার বাজান গ্রুপের হাইফা কমপ্লেক্স বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। ওই হামলায় তিনজন কর্মী নিহত হয় এবং প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও অচল হয়ে পড়ে। বাজান কমপ্লেক্স ইসরায়েলের প্রায় ৬০ শতাংশ ডিজেল এবং প্রায় অর্ধেক পেট্রোল (গ্যাসোলিন) সরবরাহ করে।