Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে পোশাক রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা, খেসারত দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের খুচরা ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১০:৪১ পিএম

বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে পোশাক রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা, খেসারত দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের খুচরা ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা

পেট্রাপোল স্থল বন্দরের একটি চিত্র। ছবি: দ্য ওয়্যার

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। এতে রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সরবরাহ ব্যবস্থা ও জীবিকার সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

ভারতের স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানিতে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞায় সরবরাহ কার্যক্রম অচলাবস্থায় পড়েছে। আর এতে করে সীমান্ত শহরগুলো কার্যত ফাঁকা হয়ে গেছে এবং সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নীতি চলতি বছরের মে থেকে কার্যকর হয়েছে। নতুন এই নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য পেট্রাপোল, হিলি, মাহাদিপুর, চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ীর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অর্থনীতির জন্য এই বন্দরগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে এই ধরনের সব আমদানি পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত গ্রামীণ বাণিজ্য পথগুলো এড়িয়ে কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর এবং হাব পেট্রাপোল। আর শুধু এই পেট্রাপোল দিয়েই ভারত-বাংলাদেশের স্থলভিত্তিক বাণিজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। নতুন নীতি ঘোষণার ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে এই বন্দর দিয়ে দৈনিক ট্রাক চলাচল ৬০০-৭০০ থেকে কমে ২০০ এর নিচে নেমে এসেছে। ফলে অনেক দোকানদারকে ক্রেতার অভাবে দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। আর এতে আনুমানিক ২০০০-৩০০০ শ্রমিকের জীবিকা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে, যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে ৩০০-৬০০ রুপি উপার্জন করতো।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পেট্রাপোল স্থলবন্দরে পণ্য লোড-আনলোড করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪-পরগনার সামির বিশ্বাস। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তার দৈনিক আয় নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। 

সামির বিশ্বাস বলেন, এই পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা শুনেছি বাংলাদেশে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি বদলাতে পারে। কিন্তু এখানে কী হবে কে জানে। আমি এখন অটোরিকশা চালানো শুরু করেছি। কত দিন আর অপেক্ষা করতে পারি?

বনগাঁও উত্তরের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনীয়া বলেছেন, এটা সত্যি যে, স্থলভিত্তিক আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার অনেক গরিব মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। সীমান্ত এলাকায় পরিবহন একটি বড় ব্যবসা এবং রাজ্য সরকার স্লট-বুকিং নীতি চালু করে এরই মধ্যে এর ক্ষতি করেছে। তবে আমি মনে করি দেশের স্বার্থে এই কষ্ট মেনে নিতে হবে।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তমুখি যশোর রোড। 

পশ্চিমবঙ্গের আন্তসীমান্ত সরবরাহ ব্যবস্থার প্রায় ৭০ শতাংশই ছোট পরিবহন অপারেটরদের মালিকানাধীন এবং এরা সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরগুলোতে দৈনিক ট্রাক চলাচল তীব্রভাবে কমে গেছে। এতে আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক তাদের আয়ের প্রধান উৎস হারানোর দ্বারপ্রান্তে। এর মধ্যে দিনমজুর, ট্রাকচালক, লোডার এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক পরিষেবা প্রদানকারী রয়েছে। এদের প্রত্যেকের জীবিকা সীমান্ত দিয়ে পণ্য চলাচলের ওপর নির্ভর করতো। 

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভারতে রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে হয় এবং এর বেশিরভাগই প্রধানত পোশাক। গত ১০ মাসে স্থলপথে প্রায় ১২ হাজার কোটি রুপির পণ্য রপ্তানি হয়েছে। নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ (স্থলপথের পরিবর্তে সমুদ্রপথে) শিপিংয়ে তিন দিনের পরিবর্তে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে, যা খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এই ব্যাপারে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বিশ্বজিৎ হালদার বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হবে বেশি। তবে তাদের বুনন শিল্পও ভারত থেকে কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। চাহিদা কমে যাওয়ায় ভারতীয় উৎপাদকরাও উৎপাদন কমিয়ে দেবে, যার ফলে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা দেবে। সীমান্তের গরিব কর্মীদের আয় কমে যাওয়ায় স্থানীয় ভোগ কমে যাবে, যা আঞ্চলিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে।

বস্ত্রের ঐতিহ্যবাহী প্রবাহে ভারতীয় তুলা ও সুতা বাংলাদেশে পোশাক তৈরির জন্য পাঠানো হতো। তারপর সেই তৈরি পোশাক ভারতের বৃহৎ বাজারের জন্য পুনরায় আমদানি করা হতো। নতুন নিষেধাজ্ঞায় সেটি ব্যাহত হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় (চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের শুরু) ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বিক্রেতারা আশঙ্কা করছেন সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হবে। এতে গ্রামীণ বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাকের ঘাটতি দেখা দেবে।

কলকাতার বড় বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী সুরেন্দ্র গুপ্ত আহতের সুরে বলেন, আমাদের বাজারে, এমনকি দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরগুলোতেও কিছু সাশ্রয়ী মূল্যের পোশাক পাওয়া যেত, যা বাংলাদেশ থেকে আসত। সেই পুরো অংশটি এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

হাওড়া হাটের ব্যবসায়ী শেখ সোহেল বলেন, বাংলাদেশ থেকে এমন দামে পণ্য আসত, যা গরিব মানুষ কিনতে পারত। এই পোশাকগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য একটি লাইফলাইন ছিল। সেগুলো এখনো এখানে পাওয়া যায়, তবে একটু বেশি দামে। বারমুডা শর্টস এবং নারীদের সস্তা পোশাকের মতো জিনিস সেখান থেকে আসত।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চালানের জন্য ভারতীয় স্থলপথের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বাংলাদেশ প্রতি বছর ভারতে আনুমানিক ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যার প্রায় ৯৩ শতাংশই ঐতিহ্যগতভাবে স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করত।

পোশাক প্রস্তুতকারকরাও সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং নতুন পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা তিন মাস পরে কার্যকরের অনুরোধ করেছেন।

দ্য ওয়্যার থেকে অনূদিত

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন