আল জাজিরার প্রতিবেদন
পেহেলগাম হামলা: ভেঙে পড়ছে ‘নতুন কাশ্মীর’ স্বপ্ন

দক্ষিণ কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় হামলার পর, ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল শ্রীনগরের ডাল লেকের তীরে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। [শরাফত আলী/রয়টার্স]
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সমর্থকদের এক সমাবেশে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি নতুন জম্মু ও কাশ্মীর গড়বে— যা হবে সন্ত্রাসমুক্ত ও পর্যটকদের স্বর্গ। কিন্তু সাত মাস পেরোতেই সেই প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়েছে।
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, কাশ্মীরের পেহেলগাম শহরে এক বন্দুকধারী গোষ্ঠীর হামলায় ২৫ জন পর্যটক ও একজন স্থানীয় টাট্টু চালক নিহত হন। এ হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও, ইসলামাবাদ সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তিন রাতের টানা সংঘর্ষ এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা
কাশ্মীর সীমান্তে টানা তিন রাত ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এর পাশাপাশি, ভারত সিন্ধু পানি চুক্তিতে (IWT) অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে এবং উভয় দেশ পরস্পরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছে। সীমান্তের একমাত্র বাণিজ্য পথ ওয়াঘা-আটারি রুটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কাশ্মীরের অভ্যন্তরেও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান শুরু করেছে। সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের পরিবারগুলোর বাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে এবং অন্তত ১,৫০০ কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা মোদির ‘নতুন কাশ্মীর’ নীতির গভীর দুর্বলতা উন্মোচন করেছে।
পর্যটনের ওপর ভরসা, বিপদের সূত্রপাত
২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করার পর মোদি সরকার সেখানে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠার দাবি করে আসছিল। সেই সময় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়, বিরোধী রাজনীতিকরা বন্দি হন এবং হাজার হাজার সাধারণ মানুষ গ্রেপ্তার হন। তারপর পর্যটন প্রবৃদ্ধিকে ‘শান্তির প্রমাণ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
২০২৪ সালে কাশ্মীরে রেকর্ড ৩.৫ মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করেন। কিন্তু তখন থেকেই বিশিষ্ট নেতা ওমর আবদুল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছিলেন— পর্যটন বৃদ্ধি প্রকৃত স্বাভাবিকতার প্রতিচ্ছবি নয় এবং পর্যটকদের টার্গেট করে হামলার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
পেহেলগাম হামলা সেই আশঙ্কাকেই বাস্তবে পরিণত করল।
অভ্যন্তরীণ সমস্যা না দেখে কেবল পাকিস্তানকে দায়ী
বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদি সরকার কাশ্মীর সমস্যাকে মূলত পাকিস্তান-সম্পর্কিত বৈদেশিক নীতির অংশ হিসেবে দেখছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমাধানের দিকটি উপেক্ষা করছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হামলার দুই সপ্তাহ আগে কাশ্মীরে নিরাপত্তা বৈঠক করলেও নতুন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে সে বৈঠকে রাখা হয়নি।
বিশ্লেষক প্রভীন ডনথি মন্তব্য করেছেন, কাশ্মীর সংকটকে এককভাবে পাকিস্তানকেন্দ্রিক ইস্যু হিসেবে দেখানো রাজনীতির জন্য সুবিধাজনক হলেও তা দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনবে না। কাশ্মীরিদের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া সেখানে টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়েও অনিশ্চয়তা
১৯৬০ সালের ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি— যা তিনটি যুদ্ধ পার করে টিকে ছিল— এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখে। ভারত চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে, আর পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, পানির প্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করা হলে তা 'যুদ্ধ ঘোষণা' হিসেবে বিবেচিত হবে। এর পাশাপাশি পাকিস্তান ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত করার হুমকিও দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের এমন সিদ্ধান্ত অপ্রাপ্তবয়স্কসুলভ হলেও এর বাস্তবিক ফলাফল মারাত্মক হতে পারে।
ঘৃণার রাজনীতির উত্থান ও বিজেপির অবস্থান
পেহেলগাম হামলার পর মোদি দেশে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে কড়া ভাষায় বলেছেন, তিনি হামলাকারীদের "পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করবেন।" বিশ্লেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় মনে করেন, মোদির কাশ্মীর নীতি মূলত দেশের ভিতরে উগ্র জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের মন জয় করার জন্য।
কিন্তু সুমন্ত্র বোসের মতে, বিজেপির কাছে কাশ্মীর কেবল রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং একটি আদর্শিক যুদ্ধক্ষেত্র। ফলে সরকারের নীতিতে কোনো তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
হামলার পর ভারতজুড়ে কাশ্মীরি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে, চিকিৎসা পরিষেবা অস্বীকার করা হচ্ছে, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে সামাজিক মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চরম উত্তেজনাময় পরিস্থিতি নির্বাচনী রাজনীতিতে বিজেপির জন্য সুবিধাজনক হলেও কাশ্মীর সমস্যার মূলে থাকা দীর্ঘস্থায়ী সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।