নিজেদের মধ্যে লড়াই করো, আরামে আছে দিল্লিওয়ালা: সালাহউদ্দিন আহমদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৫ পিএম
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মিথ্যা তথ্য ও গুজব মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। শনিবার রাজধানীর বনানীর ওমনি রেসিডেন্স হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো “জুলাই অভ্যুত্থান ও গুজবের রাজনীতি” শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এ আয়োজনের উদ্যোগ নেয় গবেষণা ও নীতিগত পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস (BCSA)। আলোচনাটির মূল লক্ষ্য ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং সেই প্রেক্ষিতে দেশে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়টি পর্যালোচনা করা।
এই গোলটেবিল আলোচনায় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, ফ্যাক্টচেকার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ ও সিভিল সোসাইটির সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীরা গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য কীভাবে রাজনৈতিক যোগাযোগ, জনমত ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে—সে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংস্কার নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে একটা অপপ্রচার রয়েছে। এটাকে গুজব বলব কিনা জানি না। বিষয়টা ঠিক উল্টো। আমরাই সবসময় ছাড় দিয়ে বিভিন্ন আইন সহায়তা করে, যেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো এক জায়গায় করে একটা সমাধান দিচ্ছি। আমরা সমাধানের কথাই বলছি।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যারা গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে দূষিত করে, অপমানিত করে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে—সেটার শেষ ফল হচ্ছে, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাসকে অপমানিত করছি। আর আমরা যদি এমনটা করি, তাহলে জয়ী হয় ফ্যাসিবাদের সময়টা ও তাদের ভূমিকা। সেটা আমাদের জাতির কেউ চায় বলে মনে হয় না।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যারা এসব কনটেন্ট বানায়, তাদের কয়েকজন ইউটিউবার আছেন। কিছু কিছু ভিডিওতে দেখি, আমার ছবি আছে কিন্তু ভেতরে আমার কথা নেই। মির্জা ফখরুল, আমার ও আরও একজন মির্জা সাহেবের ছবি দিয়ে তারা ভিডিও বানায়। কিন্তু ভেতরে আমাদের কারও কথা নেই।’
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘আবার নিচে এমন একটা লাইন দিচ্ছে, যেটাকে বলে থাম্বনেইল। সেটার সঙ্গে বক্তৃতার মিল নেই। এভাবে করে একটি জাতিকে নিয়ে তারা যেন খেলা করছে। তাদের সাবস্ক্রাইবার কারা? তারা তো একটি শ্রেণি। তারা একটি ওই রকম শ্রেণি, তারা যা বলবে, তা তারা বিশ্বাস করবে। মানে, তুমি যাহা লিখিবে, তাহাই সত্য—এমন একটা কথা প্রচলিত আছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘এখন হচ্ছে ভিডিওর জমানা। তারা এটি এমনভাবে বানায়, মানুষ ওটাই বিশ্বাস করে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, তত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এমন ভুয়া খবর বা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা তথ্য ও গুজব এমনভাবে ছড়াবে, যেগুলো মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পাঁচই আগস্টের আগে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। এরপর সব ভাই আলাদা হয়ে গেছে। এখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করো, আরামে আছে দিল্লিওয়ালা।’
এর আগে আলোচনার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার। তিনি বলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুজব ও মিসইনফরমেশন একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাইয়ের পর আমরা দেখেছি কীভাবে ভুয়া অডিও-ভিডিও ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করা হয়েছে। কখনো এসব গুজব ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের চরিত্রহনন করা হয়েছে, আবার কখনো গুজবকে ব্যবহার করে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সব পক্ষকে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে আত্মসমালোচনামূলক পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। কেউ যদি গুজব ছড়ায়, তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে; আর কেউ যদি গুজবের শিকার হয়, তার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাও জরুরি।”
ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম তার বক্তব্যে বলেন, “গুজব প্রতিরোধে আমাদের একটি সুসংহত ও কার্যকর আইনগত কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। ফেসবুকসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে, কারণ তারা বর্তমানে দেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আওতায় নয় এবং জনগণের প্রতিও তাদের জবাবদিহিতা নেই। এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে অবশ্যই আমাদের আইন ও নীতিমালার আওতায় আনতে হবে, যাতে গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়ালে তারা তা মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।”
ইন্টারনিউজের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শামীম আরা শিউলী বলেন, “গত দুই বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো গুজবগুলোর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়েছেন নারী রাজনীতিকরা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব গুজবের খুব কমই ডিবাঙ্ক বা খণ্ডন করা হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি গণমাধ্যমে একটি শক্তিশালী ফ্যাক্টচেকিং টিম থাকা জরুরি। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত একটি নির্দিষ্ট ইউনিট গঠন করা, যারা গুজব ও মিথ্যা তথ্য মোকাবেলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করবে।”
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, “ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে প্রপাগান্ডা প্রচার করছে। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা। গুজবকে আমি অসম যুদ্ধ বলি।” তিনি বলেন, “ডিসইনফরমেশন এবং মিসইনফরমেশনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটি পুরোপুরি অসম। যারা ভুয়া সংবাদ তৈরি করে তাদের কোনো যোগ্যতা লাগে না, অথচ ফ্যাক্টচেক করতে গেলে আমাদের বিশেষজ্ঞ হতে হয়।”
বিসিএসএ-এর উপপরিচালক শাহাদাত স্বাধীন অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং আলোচনার মডারেটরের দায়িত্বে ছিলেন আসিফ বিন আলী, পিএইচডি ফেলো, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি।
আলোচনায় অংশ নেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, ড. ফয়জুল হাকিম লালা, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, মাহবুব মোরশেদ (ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, বাসস), রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশরাফ কাইসার, ড. মো. সেলিম হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সাদিক মাহমুদ (ব্রেইন), প্রফেসর সালমা বেগম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সমাজকর্মী নাদিয়া নিভিন, ইন্টারনিউজের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শামীম আরা শিউলি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগি অধ্যাপক বুলবুল আশরাফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক তানভীর হাবিব জুয়েল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অ্যধাপক জালাল জালালউদ্দিন সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস (BCSA) একটি গবেষণা ও কনসালটিং সংস্থা, যা তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, কৌশলগত উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে। সংস্থাটি সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মিডিয়া, ডিজিটাল ইনোভেশন, জননীতি, পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করে।