সম্প্রতি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং মিথ্যা বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সংশ্লিষ্টতার ভুয়া ও বানোয়াট মন্তব্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে ভুয়া ফটোকার্ড বানিয়ে তার নামে প্রচার করা হয়। এমনকি তার গ্রেফতার হওয়ার গুজবও (১,২) একাধিকবার ছড়ানো হয়েছে। এই প্রতিবেদনে সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ছড়ানো বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচারযেমন মিথ্যা বক্তব্য, ভুয়া ফটোকার্ড এবং গুজবের সত্যতা যাচাই করা হয়েছে।
২ জুন, ২০২৫ তারিখে “ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দিলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিবে না” শিরোনামে সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে এমন একটি বক্তব্য ফটোকার্ড আকারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে, যেখানে সালাহউদ্দিন আহমেদের ছবি এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের লোগো ব্যবহৃত হয়। এই ফটোকার্ডে দাবি করা হয়েছে যে সালাউদ্দিন আহমেদ এমন বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু ফ্যাক্ট অর ফলস এর যাচাইয়ে দেখা যায় এটি সত্য নয়। ডিবিসি নিউজের লোগোসহ অন্যান্য উপাদান থাকলেও, ফটোকার্ডটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মূল বার্তাকে বিকৃত করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ৩০ মে প্রকাশিত ডিবিসির আসল ফটোকার্ডে দেখা যায় সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “শুধু বিএনপি নয়, পুরো জাতি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষায়।”
ডিবিসি নিউজের নকল ফটোকার্ডে নির্বাচন ইস্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদের নামে আরেকটি ভুয়া মন্তব্য ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। ফটোকার্ডে ডিবিসি নিউজের লোগো ও সালাহউদ্দিন আহমদের ছবি ব্যবহার করে ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না দিলে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে সেইটা সরকার বুঝেনা’ সালাহউদ্দিন আহমদের ছবি ব্যবহার করা হলেও এখানে লেখা হয় সালাহউদ্দিন কাদের। রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে জানা যায়, সালাহউদ্দিন আহমেদ এমন কোনো মন্তব্য করেননি এবং বিএনপিতে বর্তমানে সালাউদ্দিন কাদের নামে কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নেই। ডিবিসি নিউজও এই শিরোনামে কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদ প্রকাশ করেনি।
“ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন না হলে বিএনপি নির্বাচন ছাড়াই সরকার গঠন করার পরিকল্পনা করছে” শিরোনামে সালাহউদ্দিন আহমেদের ছবি ব্যবহার করে ফটোকার্ড ফেসবুকে ছড়ানো হয়। এই মন্তব্যটি ভুয়া এবং বানোয়াট। কারণ, এই মন্তব্যের পক্ষে কোনো গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য উৎসে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি এবং ফটোকার্ডটি সম্পাদনা করা হয়েছে। ৩ জুন ২০২৫ তারিখে বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে প্রকাশিত সালাহউদ্দিন আহমেদের উদ্ধৃতির সাথে ফটোকার্ডটির ডিজাইন ও ছবি মিল পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, মূলধারার গণমাধ্যম মানবজমিন এর ডিজাইন ব্যবহার করে সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে একটি ভুয়া ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়, যেখানে দাবি করা হয়, সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে, নইলে আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করবে।” রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায় এই ফটোকার্ডটি ভুয়া এবং মানবজমিন এমন কোন সংবাদ প্রচার করেনি।
৭ জুন, সালাহউদ্দিন আহমদকে উদ্ধৃত করে “নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা হয়েছে, এতে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি কারণ ভারত ডিসেম্বর নির্বাচন চায়” শিরোনামে যমুনা টেলিভিশনের নামে একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পাদনা করে যমুনা টেলিভিশনের নাম ব্যবহার করে এই ফটোকার্ডটি তৈরি করা হয়েছিল, যা সম্পূর্ণভাবে সম্পাদিত।
ফেসবুকে বিএনপির লোগো সম্বলিত একটি ফটোকার্ড ভাইরাল হয়েছে, যেখানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে ‘ভারতে থাকাকালীন র-এর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ’ পাওয়ার কথা বলেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। তবে, ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন বলছে, রুহুল কবির রিজভী এমন কোনো মন্তব্য করেননি এবং বিএনপিও এই ধরনের কোনো ফটোকার্ড প্রচার করেনি। মূলত, রুহুল কবির রিজভীর একটি ভিন্ন মন্তব্যের পুরোনো ফটোকার্ড (২২ মে, ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত) ডিজিটালভাবে সম্পাদনা করে এই মিথ্যা দাবিটি প্রচার করা হয়েছে, যা বিএনপির মিডিয়া সেলের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও ভুয়া বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সম্পর্কিত আরও দুটি মিথ্যা বক্তব্য ফেসবুকে সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে প্রচার করা হয়। “ভারতে ছিলাম, ‘র’ এর সাথে স্বল্প সময়ের মিটিং হয়েছে, কিন্তু আমি ‘র’ এর সক্রিয় সদস্য নই।” এবং “৫ আগস্টের আগে ভারতীয় ‘র’ এর সাথে যোগাযোগ ছিলো, তবে এখন আমার কোনো যোগাযোগ নেই”—এই দুটি মন্তব্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে প্রচার করা হয়। ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন (১,২) অনুযায়ী, সালাহউদ্দিন আহমেদ এমন কোনো মন্তব্য করেননি। এছাড়া, এই দাবির পক্ষে কোনো গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য উৎসে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে প্রচারিত অপপ্রচারগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফ্যাব্রিকেটেড কন্টেন্ট ও মানিপুলেটেড মিডিয়া ব্যবহার করে তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি। মোট ৭টি চিহ্নিত অপপ্রচারের ঘটনার মধ্যে, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ভুয়া ফটোকার্ড বা মনগড়া উদ্ধৃতি তৈরি ও প্রচার। এক্ষেত্রে, তাঁর নামে মনগড়া মন্তব্য তৈরি করে ডিবিসি নিউজ, মানবজমিন, যমুনা টেলিভিশন এবং বিএনপির নিজস্ব লোগো ব্যবহার করে সম্পাদিত ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছে।
বেশিরভাগ ভুয়া মন্তব্যই নির্বাচনের তারিখ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’-এর সাথে যুক্ত থাকা সম্পর্কিত। রুহুল কবির রিজভীর মতো অন্য শীর্ষ নেতার নামেও সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে মিথ্যা মন্তব্য প্রচার করা হয়েছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ডিজিটাল সম্পাদনার মাধ্যমে তৈরি। একাধিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল সম্পাদনার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে গণমাধ্যমের ডিজাইন ও লোগো সংযুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে, এই প্রচারণাগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিসাধন, এবং সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কৌশল ছিল উদ্ধৃতি জালিয়াতি ও ভুয়া মিডিয়া ডিজাইন তৈরি করে বক্তব্য প্রচার।
সূত্র: ফ্যাক্ট অর ফলস