ভারত বিষয়ে আল জাজিরার মতামত প্রতিবেদন
চুপ থাকো, না হলে আর দেশে ঢুকতে পারবে না

রাহুল লাই
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম

প্রফেসর নিতাশা কউল—একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বংশোদ্ভূত পণ্ডিতা, যিনি এখন যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ান। তিনি ১৯৯৭ সালে হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়তে এসে যুক্তরাজ্যে পা রাখেন। তারপর থেকে এই দেশেই বসবাস করছেন। লেখালেখি করেছেন বহু। গণতন্ত্র, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি, ভারতীয় রাজনীতি, ও কাশ্মীর নিয়ে লিখেছেন বই, আর্টিকেল মিলিয়ে দেড়শোরও বেশি।
ব্রিটিশ নাগরিক হলেও, নিজের জন্মভূমি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন ওসিআই কার্ডধারী হিসেবে। এই "ওভারসিজ সিটিজেনশিপ অব ইন্ডিয়া" (ওসিআই) হল এমন এক বিশেষ মর্যাদা যা প্রবাসী ভারতীয়দের দেওয়া হয় যাঁরা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এটি দিয়ে তাঁরা আজীবন, বারবার, অবাধে ভারতে যাতায়াত করতে পারেন। সারা বিশ্বে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ এই মর্যাদার অধিকারী।
কিন্তু ২০২৫ সালের মে মাসে, হঠাৎ করেই নিতাশা কউলের ওসিআই বাতিল করা হয়। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের ৭ডি ধারা অনুসারে ওসিআই বাতিল করা যায় নানা কারণে। যেমন প্রতারণা, ভারতের সংবিধানের প্রতি অনুগত না থাকা, শত্রু রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ, দু’ বছরের বেশি কারাদণ্ড কিংবা দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র সম্পর্ক বা জনস্বার্থে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা।
আইন অনুযায়ী কাজ হলেও, সরকারের এমন পদক্ষেপে আইনি স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের দিক থেকে বড় প্রশ্ন উঠে আসে। কারণ প্রায়শই এই বাতিলের পিছনে স্বচ্ছ যুক্তি বা তথ্য থাকে না। দেখা যায়, সরকারের সমালোচকদের নিশানা করা হয়—এ যেন এক ধরনের নিঃশব্দ প্রতিশোধ।
নিতাশা কউলকে জানানো হয়েছিল, তিনি নাকি “ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত”, এবং তাঁর বক্তব্য নাকি “মালিসপূর্ণ” ও “ইতিহাস ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে” বলা। অথচ কোন মন্তব্য বা কাজের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে, তা জানানো হয়নি।
তিনি গণতন্ত্রের পক্ষের কণ্ঠস্বর। বিজেপি সরকারের সংখ্যালঘুবিরোধী নীতি ও আরএসএসের বিভাজনমুখী রাজনীতির সমালোচনা করেছেন বারবার। কিন্তু এতে কি ইতিহাস অস্বীকার হয়? না, হয় না। বরং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সূচক দেখায়—তাঁর কথাই বাস্তবের কাছাকাছি।
ফ্রিডম হাউসের মতে, ভারত এখন “আংশিক স্বাধীন” দেশ। তারা জানায়, মোদি সরকার ও বিজেপি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বেড়েছে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ জানায়, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সংবাদমাধ্যম “অঘোষিত জরুরি অবস্থার” মুখে পড়েছে।
নিতাশা কউল একা নন। গত নয় বছরে ১২০ জনেরও বেশি ওসিআই বাতিল করেছে ভারত সরকার। শুধু ২০২৪ সালেই ৫৭ জনের ওসিআই বাতিল হয়। ২০২৫-এর প্রথম পাঁচ মাসেই বাতিল হয় আরও ১৫টি। এঁদের অনেকেই সাংবাদিক, গবেষক, অ্যাক্টিভিস্ট—যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন।
২০২২ সালে সুইডেনপ্রবাসী অধ্যাপক অশোক সোয়েনের ওসিআই বাতিল করা হয়। কারণ বলা হয়েছিল, তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে” ও তিনি “ভারতের সামাজিক কাঠামো নষ্ট করছেন”। কিন্তু এর কোনও প্রমাণ সরকার দেয়নি। ২০২৩ সালে দিল্লি হাইকোর্টে তিনি এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে জয় পান।
২০২৩-এর শেষ দিকে, র্যাফায়েল স্যাটার—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রয়টার্সের সাংবাদিক—তাঁর সমালোচনামূলক রিপোর্টের জেরে ওসিআই হারান। এখন তিনি ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
ভারতে আজ যারা ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অথবা সংবিধানবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁদের প্রায়শই চুপ করানো হয়। হয় গ্রেপ্তার, হয় হুমকি, হয় শারীরিক আক্রমণ, কখনও আবার চরিত্রহনন বা প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেওয়া।
সম্প্রতি, ভারতের কাশ্মীরে পহেলগামে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পর ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ চালায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের বিরুদ্ধে। এরপরই সরকার প্রায় ৮ হাজার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার নির্দেশ দেয়—এর অনেকগুলো সাংবাদিক বা মিডিয়া হাউসের, যেমন ফ্রি প্রেস কাশ্মীর, বিবিসি উর্দু, দ্য ওয়্যার।
ঘরোয়া সমালোচনার মুখ বন্ধ করার পাশাপাশি, এখন প্রবাসী ভারতীয়দের মুখেও তালা পরাতে চায় সরকার। ২০২৪ সালে RSF জানায়—ওসিআইকে সরকার “নীরব করতে ব্ল্যাকমেইল” করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
একটি জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ ভারত নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকেই মুখ খুলতে ভয় পান—ভাবেন, কথা বললে হয়ত দেশে যেতে পারব না।
আমরা যারা ব্রিটিশ ভারতীয়, আমাদের উচিত এই ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আমরা ভারতকে ভালবাসি—সংসার, সংস্কৃতি, আত্মীয়স্বজন—সব কিছুর টানে আমাদের শেকড় সেই দেশেই। কিন্তু এখনকার এই দমননীতির সঙ্গে ভারতের সংবিধানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কোনও মিল নেই।
যুক্তরাজ্য যেখানে ২০ লক্ষের বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভূতের বাস, সেখানে ভারত সরকারের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্যিক চুক্তি করতে গিয়ে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের বিষয়ে একটিও শব্দ না বলা হতাশাজনক। ব্রিটেনের এই নীরবতা, বিজেপির হাতই শক্ত করছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন প্রবাসীদের ভারত গড়ার কাজে ডাক দেন, তখন তাঁরই উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো। না হলে একদিন এমন আসবে, আমরা নিজের দেশেই যেতে পারব শুধু শাসকের শর্তে—না থাকবে আমাদের কথা বলার অধিকার, না থাকবে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ।
আর একবার যদি এই শেকড় কাটা পড়ে—তাহলে শুধু প্রবাসীরা না, ভারতের গণতন্ত্রও নিঃস্ব হবে।