Logo
Logo
×

অভিমত

বদরুদ্দীন উমর এবং বাংলাদেশপন্থা এবং ড্রাকুলারা

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৫৫ পিএম

বদরুদ্দীন উমর এবং বাংলাদেশপন্থা এবং ড্রাকুলারা

মৃত্যুর এক ঘণ্টা হয়নি, বদরুদ্দীন উমরকে নিয়ে নোংরামি শুরু করেছিল এবং করছে ভারতপন্থীরা। বাম ও রাম উভয়েই। রাম কারা তা আর নতুন করে নিশ্চয়ই পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। ভারতের রামপন্থী ফ্যাসিজমের দেশীয় শাখা বলে তাদের পরিচিতি রয়েছে। ভারতের বামেরা সেই ধারার বিরোধীতার করলেও বাংলাদেশের বামেদের সিংহভাগই চুপিসারে সেই রামপন্থীদেরই অনুসারী। 

বাংলাদেশে যেহেতু রাম ও বামের একই সুর, সে কারণেই মৃত্যুর পর রাম ও বামেরাই বদরুদ্দীন উমরের নিন্দা-মন্দ করছে বেশি। অবশ্য উমর নিজেই বলেছেন, বামেদের কাছ থেকে গালি ছাড়া আর কিছু পাননি তিনি। ইমতিয়াজ মাহমদু নামে এক উকিল আছেন, যিনি শ্বশুরকুলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি বামপন্থী বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সিপিবি করেন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ যে রামপন্থী তার প্রমাণ তিনি বদরুদ্দীন উমর-এর মৃত্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়াতেই দিয়েছেন। সামাজিকমাধ্যমে তিনি লিখলেন ‘বদরুদ্দিন উমরের মৃত্যু হয়েছে। উমর রাজনীতিতে মুসলমান ছিলেন, মুসলমান থেকে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’ ঠিক এই পরিমাণ ঘৃণাই তুলে রাখে ভারতের গো-রক্ষকরা মুসলিমদের জন্য। ঠিক একই লাইন ও লেন্থ। সেই একই ভাষা, একই চিন্তা। যে চিন্তা লালন করে বিজেপি, পালন করে আরএসএস। বামের নামে এরা ভয়াবহ র‌্যাডিকেল। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক। যারা একজন মৃত মানুষের শরীরেও তাৎক্ষণিক ঘৃণা ছিটাতে পারে। নুরা পাগলার মৃতদেহ যারা পুড়িয়েছে তাদের সাথে এদের চিন্তার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। সেই র‌্যাডিকেলদের শক্তি ছিল বলে তারা মৃতদেহ পোড়ানোর মতন জঘন্য কাজ করতে পেরেছে। কিন্তু ইমতিয়াজ মাহমুদদের শক্তি নেই বলে তারা বদরুদ্দীন উমরের দেহটাকে মনে মনে পোড়ায়। 

বদরুদ্দিন ওমর কিন্তু এদের কাছে একসময় ভালো ছিলেন, যখন তিনি অনেকটা তাদের সুরে কথা বলতেন। যখনই চব্বিশের বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়ালেন উমর। প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ফাদার অব ফ্যাসিজমের বিষয়ে তখন থেকেই বিষ সমান হয়ে গেলেন উমর এবং তার মার্ক্সবাদী জ্ঞান চর্চা।

সেজন্যই ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখলেন, ‘লোকে তাকে মার্ক্সবাদী পণ্ডিত মনে করে ভুল বুঝেছে সারা জীবন’। সারা আর জীবন যে এক শব্দ তা ইমতিয়াজ মাহমুদ বুঝতে পারেননি তাই আলাদা লিখেছেন, বাংলাদেশ আর চব্বিশ যে একই সত্তা তাও ইমতিয়াজ মাহমুদের মতন ডগমা আক্রান্তরা বুঝতে পারেনি কখনই। তারা মুক্তিযুদ্ধকে শুধু হিসেবে করেছে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার অঙ্কে। বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার জন্য স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে। যা ভারতপন্থার রাজনীতি বাংলাদেশে সফল হতে দেয়নি। কারণ সাম্প্রদায়িক রাম ও বামেরা কখনো বাংলাদেশপন্থার চিন্তাই করেনি। তারা এই দেশটাকে দেখেছে ভারতপন্থা ও পাকিস্তানপন্থার রাজনৈতিক বিরোধ হিসেবে। যারফলেই পঁচাত্তরে সিপাহি জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এবং তা ছিল বাংলাদেশপন্থীদের প্রথম বিপ্লব। সে বিপ্লবে সেনা ও জনতা একসাথে ময়দানে ছিল।

চব্বিশের ছত্রিশ জুলাই হলো দ্বিতীয় বিপ্লব। এ বিপ্লবেও সেনা ও জনতা একসাথে ছিল। পঁচাত্তারের পরে বাংলাদেশপন্থার রাজনীতি শুরু হয়, যার সমাপ্তি ঘটে ১৯৮১তে। তারপর আবার সেই ভারতপন্থা ও পাকিস্তানপন্থার রাজনীতি। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন, বিগত দেড় দশকে কথা বললেই, পাকিস্তান পাঠিয়ে দেবার হুংকার উঠেছে। আপনি ধর্মের কথা বললেও, উঠে এসেছে সেই পাকিস্তানপন্থার কথা। আর দেশে চর্চা হয়েছে ভয়ংকর রকম ভারতপন্থার।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে যদি আলাপ উঠান, তাহলে দেখবেন চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসানদের আধিপত্য। তাদের যত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ তার সকলের সাথে মিল খুঁজে পাবেন ভারতের, পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদের। তারা ধুতি-পাঞ্জাবিকে একরকম জাতীয় পোশাকে পরিণত করেছিল। আর এক প্যাঁচে লালপেড়ে শাড়ি। কপালে বড় টিপ। কেউ এক পা এগিয়ে কপালে সিঁদুরও দেয়া শুরু করেছিল। আর এই ব্রাহ্মণ্যবাদের নাম তারা দিয়েছিল সেক্যুলারিজম। একটা দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়ে অন্যদেশের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার এই ভয়াবহ অপচেষ্টার নাম দিয়েছিল তারা অসাম্প্রদায়িকতা, কী ভয়াবহ! যার বরকন্দাজ ছিলেন এবং আছেন ইমতিয়াজ মাহমুদের মতন মানুষেরা। যাদের টাইম-লাইন ঘুরে আসলে দেখবেন বাংলাদেশপন্থার বিরুদ্ধচারণ ও ইসলামবিদ্বেষ। ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া এদের আর কোনো কাজই নেই এবং ছিল না কখনো। 

বদরুদ্দীন উমর যখন তাদের উল্টোপথে চলা শুরু করলেন, তখন থেকেই তারা বদরুদ্দীন উমরকে শত্রুসম চিন্তা করতে লাগলেন। এখন যেমন তাদের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, একসময় বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন। আজকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশপন্থার রাজনীতির কথা বলুক। বলুক, মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত করা যাবে না, যেমন করা যাবে না হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের ওপর। মুসলমানদের নিজস্ব সংস্কৃতি এদেশেরই সংস্কৃতি। দেখবেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাদের শত্রু হয়ে উঠেছেন। এটা খুবই সিম্পল একটা বিষয়, যা শুধুমাত্র র‌্যাডিকেলদের সাথে যায়। আর যায় পলিটিক্যাল ডগমাটিকদের সাথে। 

চব্বিশের জুলাই এদের জন্য চরম একটা চ্যালেঞ্জ। এরা জুলাই বিপ্লবকে সেভাবেই দেখে, যেভাবে তারা দেখতো পঁচাত্তরের সিপাহি জনতার বিপ্লবকে। তারা সেই বিপ্লবকে বেনাম করতে, কলঙ্কিত করতে সে দিনটাকে পালন করতো ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে। জুলাই বিপ্লবকেও তারা একইভাবে ‘পুলিশ হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টারত। জুলাই বিপ্লবকে কলঙ্কিত করতে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আর তাদের সাথে ওপারের রামপন্থীদের সমর্থন তো রয়েছেই। যদিও ওপারের বামেরা এর বিপক্ষে, কিন্তু দেশের বামেরা সেই বামেদের লাইনচ্যুত হয়ে এক হয়ে গেছে রামপন্থীদের সাথে। 

চব্বিশের জুলাই তাদের কেমন গাত্রদাহের সৃষ্টি করে তার একটা উদাহরণ দিই। পরিচিত একজন, আত্মীয়ও, সে জ্বলে উঠলো বদরুদ্দীন উমর নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে আমার একটা ছোট্ট লেখায়। যেখানে আমি উমরকে উদ্ধৃতকে করেছিলাম। উমর বলেছিলেন, চব্বিশের জুলাই বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা। আমি উমরের এই কথাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করিনি। শুধু তাকে বিদায়ী স্যালিউট জানিয়েছিলাম এই বলে যে, তিনিই একমাত্র বাম যিনি সত্যিকার অর্থেই জুলাই বিপ্লবের পক্ষে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা বলার সাথেই আমার সেই আত্মীয় জ্বলে উঠলেন। মন্তব্য করলেন, কড়াভাবে। আমি জানি এদের ইতিহাস ও রাজনীতির দৌড় বিষয়ে। আমি জানি, এরা ভারতপন্থার শেখানো বুলি ছাড়া আর কিছু জানে না, পড়েনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল কীসের ভিত্তিতে তাও তাদের জানা নেই। বলতে গেলে বাংলাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে এদের জ্ঞান নিজস্ব রাজনীতির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। আড়াই হাজার বছরের বাংলা বা ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাদের নেই। যা আছে তা হলো ভারতপন্থার বয়ান। যে পন্থা, যে বয়ান শিবাজীর মতন একজন দস্যুকে দেবতা বানানোর চেষ্টা করে। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/ বর্গি এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে / খাজনা দিবো কিসে?’ সেই বর্গীদের সর্দার ছিল শিবাজী। রবীন্দ্রনাথও শিবাজী বন্দনা লিখেছিলেন। যদিও পরে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই দুঃখ প্রকাশ ছিল চাপের মুখে, সমালোচনার তীব্রতায়। ভারতপন্থার বুকে সেই মারাঠা দস্যু শিবাজীর ছবি। বুকে লালন করে সেই শিবাজীর প্রতিহিংসা, ধ্বংসের আকুতি। 

এই র‌্যাডিকেল রাজনীতির অনুসারীরা, ডগমাটিকরা বাংলাদেশপন্থার কথা শুনলেই ক্ষেপে যায়। অনেকটা ড্রাকুলার মতন, যে ক্রুশ দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যেত, ক্রোধে জ্বলে উঠতো। ৭ নভেম্বর ও ৩৬ জুলাই হলো সেই ক্রুশ, যা দেখলে এযুগের ড্রাকুলারা ভয় পায়, ক্রোধে জ্বলে ওঠে। কিন্তু তাদের মূলত করার কিছু নেই। যতবার তারা রক্তখেকো হবে ততবারই প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। ইতিহাসের সঠিক পাঠ থাকলে তারা জান তো, এই ভূখণ্ড কখনো পরাভব মানেনি। সাময়িক পরাজিত হয়েছে হয়তো। কিন্তু প্রতিরোধে পিছ-পা হয়নি।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন