ট্রাম্প প্রশাসনের ৬০০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল যে বার্তা দেয়
উগ্র দক্ষিণপন্থী ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র হেলেদুলে উঠেছে। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে হররোজ বোমা মেরে মানুষ খুন করায় সমর্থন প্রদান, চরম হঠকারিতার পরিচয় দিয়ে ইজরাইলকে ইরান হামলার দুঃসাহস যোগানো, ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া নীতি, বার্মা অ্যাক্ট, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের ভূ-রাজনীতি পুরো খোলনলচে বদলে গিয়েছে। ফলে ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি ভিন্ন হতে যাচ্ছে এটা শুরু থেকেই সবাই মনে করেছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের উপর ট্যারিফ আরোপের মধ্য দিয়ে সেই বার্তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এরই মধ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি আন্তর্জাতিক ছাত্র ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
প্রশাসনের ভাষ্য, অধিকাংশ ভিসা বাতিল করা হয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় দেশে অবস্থান, আইন ভঙ্গ বা নানা অপরাধের অভিযোগে। পাশাপাশি কয়েক শত শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে “সন্ত্রাসবাদে সমর্থন” প্রদানের অভিযোগে। প্রথম দর্শনে এটি কঠোর আইন প্রয়োগের ঘটনা বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরে গেলে স্পষ্ট হয়, এই পদক্ষেপ আসলে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
শিক্ষা ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে বাড়ছে। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে অভিবাসন নীতি যে আরও কঠোর হবে, তা অনুমেয় ছিল। কিন্তু এবারের নীতির বিশেষ লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। যারা ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন বা প্রো-প্যালেস্টাইন আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র মাহমুদ খালিল কিংবা টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রুমেইসা ওজতুর্কের গ্রেপ্তার এই বাস্তবতারই প্রমাণ। নির্বাহী আদেশের আড়ালে রাজনৈতিক মতপ্রকাশকে দমন করা হচ্ছে, যা আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
আমেরিকা এতোদিন বলে এসেছে শিক্ষা কখনো কেবল পাঠ্যক্রমের সীমায় আবদ্ধ থাকে না; এটি মুক্ত মতবিনিময় ও সমালোচনার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারায়, তবে সেটি আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক প্রকার নিয়ন্ত্রিত শিবিরে পরিণত হবে। আর সেই পরিস্থিতি স্পষ্ট হচ্ছে হার্ভার্ড তার গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে সৃষ্ট বৃহত্তর সংকটের মধ্যে দিয়ে। এই পরিস্থিতি কেবল কিছু শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যে সীমিত নয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে প্রশাসনের সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তা আসলে বৃহত্তর সংকটের প্রতীক।
ফিলিস্তিন ইস্যু সামনে রেখে ট্রাম্পের প্রশাসন কিছু নির্লজ্জ রূপান্তর এনেছে। সেখানে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি নীতি পরিবর্তনের দাবি, রক্ষণশীল মতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাপ, গবেষণা অনুদান স্থগিতের হুমকি—সব মিলিয়ে বোঝা যায়, উচ্চশিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করার এক সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল তারই অংশ।
তবে একটা কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বমানের মেধার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা কিংবা সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অবদান অপরিসীম। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশই কোনো না কোনো সময়ে আমেরিকায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ছিলেন। আজ যদি এই শিক্ষার্থীদের ওপর অবিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে আগামী দিনে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রতিযোগিতামূলক শক্তি হারাবে। এর বিপরীতে পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানপর্বের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
প্রশাসনিক জটিলতা নাকি রাজনৈতিক শাস্তি এই ভিসা বাতিলের মূলে কোন ঘটনা কাজ করেছে? সবাই জানেন মূল ঘটনা কী? এখানে নতুন করে বলার কিছু নাই। গত এপ্রিল মাসে একদিনে হাজারো শিক্ষার্থীর রেকর্ড মুছে ফেলার ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, প্রশাসনিক ভুলত্রুটি নয় বরং এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করার নীতি এখানে কার্যকর। শিক্ষার্থীদের হঠাৎ করেই “অবৈধ” নাগরিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আদালত ও জনমতের চাপের মুখে প্রশাসন সিদ্ধান্ত বদলালেও, শিক্ষার্থীদের মনে যে ভয় ও অনিশ্চয়তা জন্মেছে, তা সহজে কাটবে না। আর ট্রাম্প প্রশাসন এটাই চায় যে শিক্ষার্থীরা ভয় পাক। আর যাই হোক আমেরিকা ইসরাইলের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যতোই সমর্থন দিক সেখানে যেন শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে না যায়। অন্তত ভিসা বাতিলের ভয়েও যেন তারা নীরব থাকে।
তবে যাই হোক, যদি সত্যিই কোনো শিক্ষার্থী অপরাধ করে, তবে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় তাকে শাস্তি দেওয়াই যুক্তিসংগত। কিন্তু কয়েকজনের অপরাধের দায় হাজারো শিক্ষার্থীর ওপর চাপানো, কিংবা রাজনৈতিক মতামতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা—এটি কোনো সভ্য রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ছে। উগ্র দক্ষিণপন্থী জায়নবাদী নেতা হিসেবে স্বল্প মেয়াদে এই পদক্ষেপ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য রাজনৈতিক লাভ বয়ে আনতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ফল হবে আমেরিকার জন্য আত্মঘাতী।
আমেরিকার এই নির্লজ্জ কিছু ভূমিকার কারণে ইতোমধ্যে কানাডা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদি আমেরিকা অবিশ্বাস ও ভয়ের আবহ তৈরি করে, তবে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা অন্যত্র মুখ ফেরাবে। আমেরিকার গবেষণা, উদ্ভাবন ও বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এই বিষয়গুলোকে ট্রাম্পের প্রশাসন থোড়াই কেয়ার করে। তারা এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই পাত্তা দিচ্ছে না। উল্টো নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, গ্রেফতার, নাগরিকত্ব হননের মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা প্রবাসীদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়। ফিলিস্তিনে ইজরাইলের গণহত্যা থেকে শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসনের সব ধরনের অমানবিক কর্মকাণ্ডগুলোকে রুখে দিতে চেষ্টা করা মানুষগুলো যাতে পুরোটা সময় মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকে এটাই ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধানতম লক্ষ্য। আর সম্প্রতি ৬০০০ শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিচ্ছে যে আমেরিকায় থাকতে হলে ‘গান্ধীজীর বানর’ হয়েই থাকতে হবে, সেখানে নেতাজীর মতো বিপ্লবী হওয়ার সুযোগ নাই। আর অভিবাসী শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসে কুসুম কুসুম মানবাধিকার সংগ্রাম কিংবা বিপ্লব করতে চাইলে আমেরিকার মাটি ত্যাগ করে নিজ দেশে গিয়ে করার বিকল্প নাই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।