Logo
Logo
×

অভিমত

এলডিসি থেকে উত্তরণের এখনই কি যথার্থ সময়?

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৯:২৯ পিএম

এলডিসি থেকে উত্তরণের এখনই কি যথার্থ সময়?

স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কাছে কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট  (সিডিপি) এর মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। সিডিপি একটি দেশের তিনটি সূচককে ভিত্তি ধরে ত্রৈবার্ষিক পর্যালোচনা সাপেক্ষে তাদের মূল্যায়ন পেশ করে। সূচক তিনটি হচ্ছে—  মাথাপিছু আয়,  মানব সম্পদ  এবং জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এই তিন সূচকের যে কোন দুটিতে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় অথবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ হতে হয়।এই মানদণ্ড অবশ্য সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়।পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা করে এবং সেই অনুসারে ইকোসকে রিপোর্ট প্রণয়ন করে সিডিপি। তিন বছর সময় দেওয়া হয় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য উঠে এবং  চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে যায় একটি দেশ।  ২০১৮ এবং  ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক  মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এই যোগ্যতা অর্জন করলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।উল্লেখ্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় নির্ধারণ করে।

১৯৭১ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকাভুক্ত হয় দেশ। বর্তমানে ৪৪ টি দেশ এলডিসি'র অন্তর্ভুক্ত।  জনসংখ্যা,  অর্থনৈতিক সক্ষমতা, ছোট দ্বীপপুঞ্জ, ভূবেষ্টিত দেশ— এসব বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি  করে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতিসংঘ।  বাংলাদেশকে জনসংখ্যার আধিক্যের বিচারে অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম; এই বিশেষ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল জাতিসংঘ।

বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী সরকারের একটা প্রবণতা ছিল সমস্ত সরকারি পরিসংখ্যানকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো। জিডিপি গ্রোথ থেকে শুরু,  মাথাপিছু আয় সবধরনের পরিসংখ্যান জনসমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্র সরকারি হস্তক্ষেপ ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তাই সরবরাহকৃত পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ছিল তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। কারণ ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ২৭৯৩ ডলার যা তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না।

ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স( আই সিবি) আয়োজিত একটি  সেমিনারে চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুর রহমান,  এলডিসি থেকে উত্তরণকে ৩ থেকে ৬ বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ১৩ শতাংশ কম বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তিনি বলেন “ আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ সমর্থন করি, কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দরকার। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গত বছরের আগস্ট থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীদের আস্থায় প্রভাব পড়েছে!”

এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য আই সিবি পাঁচটি যুক্তি তুলে ধরে:

১. ভালো বাণিজ্য দর কষা-কষির জন্য।

২. তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা।

৩.শিল্প খাতে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা।

৪.বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ।

৫. প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানো এবং জলবায়ু সহনশীলতা টেকসই করা।

আইসিবি থেকে জানানো হয় এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক বাড়বে ১২ শতাংশ। আর জিএসপি সহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রপ্তানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ।

এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটি দিকই আছে। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অস্থির সময় পার করছে। ২০২৪ এর বহুল কাঙ্ক্ষিত গণঅভ্যুত্থান এর আগে দেশ একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ছিল, অভ্যুত্থানের পরেও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির  আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। আইসিবি খুব যৌক্তিকভাবে বর্তমান বাস্তবতাকে পর্যালোচনা করার জন্য বলেছে। এলডিসি থেকে এই মুহূর্তেই উত্তরণ হলে গার্মেন্ট ও ওষুধশিল্পে এবং বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে যে সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত যে সুবিধা এখন  পাওয়া যাচ্ছে তা আর পাওয়া যাবে না।

ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু ওষুধের ক্ষেত্রে কোন পেটেন্ট ( মেধাস্বত্ব) মূল্য এখন পর্যন্ত দিতে হয় না তাই পেটেন্ট মূল্য দিতে হলে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে। যদিও ২০৩৩ সালের পর ওষুধের পেটেন্ট( মেধাস্বত্ব) মূল্য পরিশোধ করেই  কিনতে হবে। ওষুধ শিল্পে  ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান রয়েছে, প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার দেশীয় বাজার রয়েছে এবং ২০২৪ সালে ওষুধ রপ্তানি আয়ে এসেছে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এ অর্জনের পেছনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস ছাড়ের অবদানকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতে হবে যা বাংলাদেশকে পেটেন্টকৃত ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ কম খরচে উৎপাদনের সুযোগ দিয়েছে।   কিন্তু এখনই এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে ওষুধ শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। 

বাংলাদেশ সহজ শর্তে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ পায়, কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণে সহজ শর্তের ঋণ বন্ধ হবে। জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। স্বল্পোন্নত দেশের সরকারি কর্মকর্তারা জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতে সৌজন্য টিকিট পান— এটা বন্ধ হয়ে যাবে।

পক্ষান্তরে একটি দেশকে কোন না কোন সময় এলডিসি থেকে উত্তরণ হতেই হবে। কেও উন্নত হতে চাইবে না এটা হতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে কী সুবিধা পাবে বাংলাদেশ? বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপভাবে বাড়বে, কিন্তু তার জন্য বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশকেই তৈরি করতে হবে। বেশি সুদে বড় আকারের ঋণ পাওয়া যাবে। এলডিসি থাকা অবস্থায় ১% সুদে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেলে, উন্নয়নশীল অবস্থায় ৪% তেকে৫% সুদে ১৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া যাবে। বেশি ঋণ পেলে অবকাঠামো এবং মানব সম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি খরচ করতে পারবে বাংলাদেশ। অন্যান্য দেশগুলো বাংলাদেশকে গরীব দেশের চোখে না দেখে মর্যাদার চোখে দেখবে, তাদের বন্ধুর মত আচরণ করবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।গার্মেন্ট সহ অন্যান্য রপ্তানিজাত পণ্যের আওতা বৃদ্ধি পাবে।

থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক সানিয়া রিড স্মিথ বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের সময়। এরপর বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনীতি ও বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি গত ২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক বাণিজ্য ধাক্কা তৈরি করেছে। ফলে এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ  পেছানোর যৌক্তিকতা তৈরি করে দেয়।” মিয়ানমার, তিমুর সহ বেশ কয়েকটি দেশ জাতিসংঘের কমিটি পর্যায়ে মানদণ্ড পূরণ করেও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে উত্তরণ পিছিয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নাজুক পরিস্থিতিতে এলডিসি থেকে উত্তরণের সবগুলো দিক নিয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে এগুনো উচিত। যেকোনো সফলতার জন্য একটি সঠিক সময় খুব জরুরি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত যে কোন বৈরী অবস্থাকেও স্বস্তির দিকে নিয়ে আসতে পারে।

মোদ্দাকথা এলডিসি থেকে বের হলে অসুবিধাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আরোপিত হবে, কিন্তু সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে। যেহেতু একটি নির্বাচিত সরকারের সময় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে,  তাই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নতুন সরকারই এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান,

www.engr-salahuddin.com

[email protected]

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন