Logo
Logo
×

অভিমত

৫ আগস্ট আমরা কীভাবে বিজয়ী হলাম?

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৫:১৫ পিএম

৫ আগস্ট আমরা কীভাবে বিজয়ী হলাম?

৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই), ২০২৪-এ হাসিনার পলায়নের এক বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে আমরা। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুলাই ছিল ভিন্ন। কিন্তু যেটা তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হচ্ছে এই একবছরের মধ্যে একবারও ৭৬ বছরের পুরোনো দল আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি বাংলাদেশে। হাসিনার পাপের ভারে পুরো দলটাই আজ নিমজ্জিত। এটাই হওয়ার কথা।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন বেগম খালেদা জিয়া খুব সচেতনভাবে বর্জন করেছিলেন। খালেদা জিয়া জানতেন একটি দলের রাজনীতি যেনতেনভাবে কয়েকবছর ক্ষমতায় থাকা নয়— বরং একটা দলের রাজনীতি হওয়া উচিত আদর্শভিত্তিক এবং যার মাধ্যমে দলটি টিকে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দীর পর শতাব্দী। হাসিনার বয়ান ছিল পুরোই উল্টো। হিওম্যান সাইকোপ্যাথ হাসিনা আমিত্বকে ভালোবাসতেন প্রচুর। আমিই সব করেছি এই বয়ানের পাশাপাশি রাজাকার ট্যাগটাকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন বিরোধীদলকে কোণঠাসা করার জন্য—অথচ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠাই করেছিল বিএনপি ২০০১ সালে। নিপীড়নই ছিল হাসিনার প্রধান অস্ত্র আর এর মাধ্যমেই নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত নানন কলাকৌশলের মাধ্যমে নির্বাচন করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।

বেগম খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সাময়িকভাবে সুশীল সমাজের একটা অংশের কাছে নেতিবাচক হলেও উনি আদর্শিক এবং জন-অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যার ফলে বিএনপি এবং বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ  আদর্শিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বয়ানে আরেকটা ছিল উন্নয়নের কথা। নিজের মনপ্রসূত উন্নয়নের জন্য  প্রত্যেকটা প্রকল্পের নির্মাণমূল্য দুই, তিন চার গুণ বৃদ্ধি পেত। যেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১০১৬১ কোটি টাকা তা শেষ হল ৩০১৯৩কোটি টাকায়— কোন জবাবদিহিতা ছাড়া। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল প্রত্যেকটা প্রকল্পের নির্মাণ মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটকে বৈধতা দেয়ার জন্য ২০১০ সালে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়। কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতকে টাকাচুরির একটা কারখানায় পরিণত করা হয়। এই উন্নয়নের বয়ান ছিল তার নিত্যসঙ্গী। প্রতিটা বিদেশ সফর থেকে এসে তার চরম অনুগত সাংবাদিকদের তোষামোদে আহ্লাদিত হতেন। কিছু কিছু সাংবাদিক পেশাগত দায়বদ্ধতার কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের স্বার্থের জন্য হাসিনার পদলেহন কারীতে পরিণত হয়েছিলেন।

দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা সমাজ ও দেশ থেকে উঠে গিয়েছিল! সংসদে বসত সং দের আসর! সংসদ নেতাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্নজনের স্বরচিত গান, কবিতা পাঠ চলত। আওয়ামী লীগের তৈরীকৃত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ছিল তাদের একটি অঙ্গসংগঠনের মত, যারা সমভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার জন্য দায়ী— হাসিনার সকল অপকর্মের সঙ্গী।

২০১৮ সালে কীভাবে দিনের ভোট রাতে করা হয়েছিল, তা সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা এবং প্রাক্তন আই জি পি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায়। বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলয় ফরমায়েশি রায়ে  জেলে নিয়েবিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে, কর্মীদেরকে জেলে রেখে দিনের ভোট রাতে করল। গণতন্ত্রের প্রতি ন্যূনতম কোন দায়বদ্ধতা শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের ছিল না— যেমন টা ছিল না শেখ মুজিবুর রহমানের। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র চারটি পত্রিকার সার্কুলেশন জারি রেখে অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার অপশাসন, দুর্নীতি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা পরবর্তী শাসনেরই অনুকরণ বা তার চেয়েও অনেক ভয়ংকর। রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে যেমন মানুষকে হত্যা ও গুম করা হতশেখ হাসিনার শাসনামলে গুম খুনের মাত্রা তার কয়েকগুণ হয়েছিল। গুমখুনের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ ১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে, বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে RAB এবং শীর্ষ স্থানীয় ৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে স্যাংশান দিয়েছিল। বিরোধী দলের উপর  চরম দমন-পীড়নের কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন থেকে চিঠি দিয়েও সতর্ক করা হয়েছে সরকারকে।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের অনাচার নিয়ে প্রতিনিয়ত বলতেন, আল্লাহর দরবারে সহ্য হবে না। তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়েও মানুষের মনোজগতের ভেতরের কষ্টের আবেগকে উনার কথায় তুলে ধরেছিলেন। সাধারণ রিকশাওয়ালা রা বলত, ফেরাউনের পতন হয়েছে! আর হাসিনার পতন হবে না! নৃশংস হাসিনা মানুষের মনোজগতকে অপশাসনের মাধ্যমে পুরোপুরি বিষিয়ে তুলেছিলেন।

একজন মা যখন হঠাৎ করেই জানতে পারে, সকালে মিছিলে যাওয়া তার ছেলেটির( সাজেদুল ইসলাম সুমন- ছাত্রদল  নেতা) কোন হদীস নেই, অথবা একজন স্ত্রী যখন তার স্বামীর গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা  ( ছাত্রদল নেতা জনি) মৃতদেহ নিয়ে প্রশ্ন করে “ একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি লাগে?” তখন এর উত্তরের জন্য মানুষ আন্দোলনের পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তার কাছেও ফরিয়াদ করত। গুম হওয়া ইলিয়াস আলীর ছোট শিশুটি আজ বড় হয়েছে, কিন্তু জানতে পারেনি তার বাবা জীবিত না মৃত! সাংবাদিক সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের কোন সুরাহা পর্যন্ত হয়নি। একের পর এক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পেছানো হয়েছে।

এরকম অজস্র, অগণিত নারকীয়  ঘটনাবলীর জননী শেখ হাসিনা। মানুষ ফুঁসে উঠেছে সময়ে সময়ে। সবচেয়ে নির্যাতিত দল হিসেবে বিএনপি অপরাপর রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে প্রতিনিয়ত ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে। বিএনপির মহাসচিব সহস্থায়ী কমিটির প্রায় সব সদস্য নিয়মিতভাবে গ্রেফতার হতেন। তাদেরকে জামিন দেওয়া হত না। এই ছিল আওয়ামী শাসন।

শুধুমাত্র একটি নির্বাচনের ভয়ে এবং বিরোধী দলকে নির্বাচনে মোকাবিলা করার ভয়ে এবং লুটপাটের মাধ্যমে টাকা পাচারের নৈসর্গিক স্বাদ নেওয়া যেন বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্যশেখ হাসিনা বাংলাদেশের — বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সহ সংবিধিবদ্ধ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতনভাবে ধ্বংস করেছেন।

 ২০২৪ এর আমি আর ডামি নির্বাচনের পর হাসিনার আক্রমণাত্মক মনোভাব চরমভাবে বাড়তে থাকে! বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন খুব দ্রুতই জনপরিসরে হাসিনা পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। নানান মত ও পথের মানুষ তাদের দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা ও নিপীড়িনের বদলা নেওয়ার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। শিশু, শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী অকাতরে প্রাণ দিতে থাকে এই আন্দোলনে। পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী ১৩৩ জন শিশু, ২০০ এর অধিক শ্রমজীবী, ২০০ এরও অধিক শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৪০০ এর ও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৩০০০ এর বেশি মানুষ। মানুষের মনকে বিদীর্ণ করে ফেলে এই হত্যাযজ্ঞ। গত জুলাই মাসেবিশেষ করে ১৬ ই জুলাইয়ের পর থেকে মানুষ  নিজেকে আর ঘরে আটকে রাখতে পারে নি। হাসিনার সমস্ত বয়ান তখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অভিভাবক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, ডাক্তার, প্রকৌশলী সবাই যার যার জায়গা থেকে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। মানুষের বিদ্রোহী মনকে হাসিনার পদলেহনকারী রাষ্ট্রীয় বাহিনী, বুলেট, প্রাণঘাতী অস্ত্র কিছুই রুখতে পারেনি। এ ছিল এক সম্মিলিত প্রয়াস। বন্ধু তার সহযাত্রীর গুলিবিদ্ধ দেহ টেনে নিয়ে আসার সময়,গুলি, ট্যাংক থেকে অর্ধমৃত দেহকে ধাক্কা  দিয়ে ফেলে দিয়ে গুলি, বহুতল ভবনের কার্ণিশে ঝুলে থাকা যুবককে একের পর এক গুলি করছে— কিন্তু জনতার প্রতিরোধ থামছে না। হাসিনার পতন ছড়া মানুষের আলাপ আলোচনায় আর কিছুই ছিল না। কারফিউ জারি করা আবার শিথিল করা ; স্কুলকলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়অফিস আদালত সরকারি ছুটি দেওয়া, শ্যুট এট সাইট ঘোষণা দেওয়া কোন কিছুই হাসিনাকে আটকাতে পারে নি। শেখ হাসিনা মানুষকে হত্যা করার সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে পদত্যাগ করে তার গত ১৫ বছরের পাপ মোচনের কোন পদক্ষেপ নেন নি। তিনি মেট্রো স্টেশন পোড়ার জন্য চোখের পানি ফেলার নাটক করেছেন কিন্তু এত এত সন্তান শহীদ হওয়ার জন্য কোন চোখের পানি ফেলেন নি। তার তথ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত  আন্দোলনকারীদের এডিক্টেড বলে কটাক্ষ করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেন নি।।

হাসিনার পতন অনিবার্য  ছিল। রক্তে রঞ্জিত যার হাত, রক্ত পিপাসু যেপ্রাকৃতিক ভাবেই তার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল। মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অপরিসীম ত্যাগ এবং একটি গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন দেশ পাওয়ার অভিপ্রায় মানুষকে হাসিনা পতনের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ বিএনপির বিভিন্ন শীর্ষ স্থানীয় নেতারা যখন হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন— পালানোর পথ খঁুজে পাবেন না; তখন হাসিনা প্রত্যুত্তরে বলতেন — শেখ হাসিনা পালায় না।

বাংলাদেশ বনাম আওয়ামী লীগের যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে; ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে।  শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে। মানুষের ঐক্যবদ্ধ জনস্রোত এমন পর্যায়ে গিয়েছিল, শেখ হাসিনা সেদিন দেশে থাকলে তার দেহাবশেষের কিয়দাংশও খুঁজে পাওয়া যেত না। মানুষের মনের ক্ষোভ এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

জুলাই শেষ হয়ে যায়নি। জুলাইয়ের অনুভূতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের মনে জাগরুক থাকবে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকবে, জুলাইয়ের শহীদদের আত্মত্যাগকে ধারণ করে বাংলাদেশে বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলো অবিচল থাকবে এই প্রত্যাশা।

 প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

www.engr-salahuddin.com, [email protected]

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন