দুশ্চিন্তা নয়, সহজ কয়েকটি অভ্যাসেই শিশুদের জন্য গঠনমূলক স্ক্রিন সময় সম্ভব

কেটলিন রেগার
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৪ পিএম

যুক্তরাজ্যের প্রেক্ষাপটে লেখা এই অভিমতটি বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সব দেশের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য।
এই গ্রীষ্মে যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তি সচিব পিটার কাইল ঘোষণা দেন যে, শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে দিনে দুই ঘণ্টার সীমা নির্ধারণের কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রস্তাব এখনকার বাস্তবতা অনুযায়ী শুধু অপ্রতুল নয়, অনেকটাই পুরোনো।
গ্রীষ্মকাল মানেই শিশুদের অবসরে স্ক্রিনে সময় কাটানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়া এবং সেই সাথে অভিভাবকদের দায়িত্বও বেড়ে যায়। এই সময়ে কাইলের ঘোষণা মনে করিয়ে দেয় পুরনো কিছু দিকনির্দেশনার কথা, যা মূলত শুধু স্ক্রিনের সময় নির্ধারণ করে। কিন্তু স্ক্রিনে কত সময় কাটানো হচ্ছে, সেটা দেখলেই আসল সমস্যার সমাধান হয় না। দেখা দরকার, সেই সময় কী ধরণের কনটেন্ট দেখা হচ্ছে। আমি একজন মা এবং একজন শিক্ষক হিসেবে বুঝি, সরকার যদি এখনো সঠিক পথে না-ও চলে, আমরা অভিভাবকরা কিছু পরিবর্তন আনতে পারি।
গত দশকে শিশুদের মোটা হয়ে যাওয়া এবং স্থূলতার সঙ্গে স্ক্রিন টাইমের সম্পর্ক নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তখন থেকেই অভিভাবক ও শিক্ষকরা স্ক্রিন টাইম সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এটা ছিল শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের উপর স্ক্রিন কনটেন্টের প্রভাব নিয়ে আলোচনা ছিল খুব কম।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক শিশু যদি পরিবারের সঙ্গে বসে CBeebies দেখে এবং আরেক শিশু যদি একা বসে ইউটিউব শর্টস দেখে, তখন দুইজনের স্ক্রিন টাইম সময়ে মিল থাকলেও মানে একেবারেই আলাদা। একজন যুক্ত হচ্ছে পরিবারের সঙ্গে, আলোচনা হচ্ছে, শেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আরেকজন একা, কোনো সংলাপ বা গল্প ছাড়াই দ্রুত পাল্টে যাওয়া ক্লিপ দেখছে, যা তার মনোযোগ বিভ্রান্ত করছে। এই দুই অভিজ্ঞতার মানে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
বর্তমানে ইউটিউবই জেনারেশন আলফার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত টিভি মাধ্যম। তিন থেকে সতেরো বছর বয়সী যুক্তরাজ্যের ৮৮ শতাংশ শিশু এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। অথচ ইউটিউব নিয়ে সরকারিভাবে কোনো আলোচনা হচ্ছে না, এমনকি কাইলের বক্তব্যেও এটি ছিল অনুপস্থিত।
স্ক্রিন টাইম নিয়ে “অ্যাকটিভ” এবং “প্যাসিভ” টাইমের ধারণাও এসেছে। যেমন, গেম খেলা বা হোমওয়ার্ক করা হলে সেটা অ্যাকটিভ টাইম। আর চুপচাপ বসে কিছু দেখা হলে সেটা প্যাসিভ। যুক্তরাজ্যের Royal College of Paediatrics and Child Health বা আমেরিকার American Academy of Child and Adolescent Psychiatry এই পার্থক্যের গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু এই ভাবনাগুলো এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েনি।
আমি যখন বলি, শিশুদের কী দেখছে তা নিয়ে সচেতন হতে হবে, তখন আমি চাই না কেবল ব্যক্তিগত দায়িত্বের উপর সব চাপানো হোক। কারণ আমরা এখন এক বিশাল ডিজিটাল জনস্বাস্থ্য সংকটে রয়েছি। আমেরিকার সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থি বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের উদ্বেগ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন বড় মাপের নীতিগত পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির নকশাগত সমস্যা নিয়ে কাজ করা।
কাইল যেসব প্রস্তাব রাখছেন, সেগুলো যেন পুরনো কোনো ফাইল থেকে তোলা না হয়। বরং তিনি যেন ভাবেন, কী ধরণের ব্যবহার শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে এবং প্রযুক্তির ভিতরকার কাঠামোতে কী পরিবর্তন দরকার।
এই মুহূর্তে অভিভাবকদের হাতেই অনেক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বড় এবং চাপের, আমি জানি। কিন্তু আমি নিজে কী করছি, সেটার কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
ছোট শিশুদের জন্য স্ক্রিনের বাইরে সময় কাটানোই ভালো। আর যখন স্ক্রিন ব্যবহার করি, তখন তাদের CBeebies বা CBBC দেখাই। কারণ সেখানে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কনটেন্ট থাকে, যা শিশুদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
শুধু দেখানো নয়, এমন কিছু কনটেন্ট দিন যেগুলো আলোচনা তৈরি করে, সৃজনশীলতা বাড়ায়। পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা গেলে আরো ভালো। এতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে।
ছোটবেলা থেকেই ডিজিটাল কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনামূলক চিন্তা তৈরি করুন। যেমন, সন্দেহজনক ছবি চেনার জন্য Sightengine ব্যবহার করা যায়। এতে শিশুরা শিখবে কোন ছবি আসল, কোনটা মিথ্যা।
বড় শিশুদের সঙ্গে বসে আলাপ করুন তারা কী ধরণের কনটেন্ট দেখতে চায়। একসাথে ভালো লাগা বিষয়গুলো খুঁজে দেখুন, যেন স্ক্রিন ব্যবহারে আনন্দ আর শেখার সুযোগ তৈরি হয়। যেটা ভালো লাগে না, সেটাকে অগ্রাহ্য করা শিখান। এমনকি তাতে মন্তব্য করাও নিরুৎসাহিত করুন, কারণ সেটাও প্ল্যাটফর্মকে উৎসাহ দেয়।
পুরো পরিবার মিলে “অনুপ্রেরণাহীন” কনটেন্ট পরিষ্কার করার কাজ করতে পারেন। যেসব অ্যাকাউন্ট বা পেজ এখন আর আনন্দ দেয় না বা কিছু শেখায় না, সেগুলো আনফলো করুন।
টার্গেটেড বিজ্ঞাপন থেকে বাঁচতে DuckDuckGo বা Firefox Focus ব্যবহার করুন, কারণ এগুলো আপনাকে ট্র্যাক করে না। Startpage-ও ভালো বিকল্প, যা গুগল ব্যবহার করে কিন্তু আপনার তথ্য জমা রাখে না।
সরকার যদি এখনো প্রযুক্তিকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, আমরা অন্তত নিজেদের ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে পারি। পরিবার থেকেই শুরু হোক সমালোচনামূলক, সচেতন এবং স্বাস্থ্যকর স্ক্রিন ব্যবহার শেখানো। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান