Logo
Logo
×

অভিমত

রাইট চয়েস, যোগ্য চেয়ার, রাজনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৬:০১ পিএম

রাইট চয়েস, যোগ্য চেয়ার, রাজনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার

শহীদ জিয়া সাইফুর রহমানকে খুঁজে বের করেছিলেন, কারণ তার একজন অর্থনীতি জানা মানুষ দরকার ছিল। অথচ সাইফুর রহমান অর্থনীতিবিদ হিসেবে ‘ফোকাস্ড’ মানুষ ছিলেন না। তাকে শহীদ জিয়া বাণিজ্যমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে বাণিজ্যমন্ত্রী বানানোতে খোদ বিএনপির অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু আখেরে দেখা গেল সাইফুর রহমান ছিলেন রাইট চয়েজ। শহীদ জিয়া মানুষ চিনতেন, বুঝতেন কাকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে। পরবর্তীতে সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের সফলতা প্রমাণ করেছেন। বর্তমান সরকারও তেমনি কিছু মানুষকে খুঁজে বের করেছেন, যারা তেমন ‘ফোকাসড’ ছিলেন না। 

এখন ‘ফোকাস্ড’ এর ব্যাপারটায় আসি। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। অর্থাৎ আমাদের দেশে গুণ-বিচারটা পরে হয়, আগে হতে হয় দর্শনধারী। অমুক নেতা, সে যোগ্য হোক আর নাই হোক, তাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসাতে হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমে দেখেছি এমন অনেককেই। তাদের শুধুমাত্র আনুগত্য তথা তোষামোদির কারণেই রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়, নামও বলা যায়। অযোগ্যদের নাম বলে সময় নষ্ট না করি। তারচেয়ে যোগ্যদের পক্ষে কথা বলি। 

শহীদ জিয়া বুঝতেন কাকে দিয়ে কাজটা হবে। তেমনি বর্তমান সরকারও কিছু লোককে ‘চুজ’ করেছেন যারা সত্যিকার অর্থেই যোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক বিষয়ে ‘ডিল’টার কথাই বলি। ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক থেকে আমাদের যে টিমটি ছিল নেগোসিয়েশনে তারা ১৫ শতাংশ শুল্ক কমাতে পেরেছে। ফলে আমাদের শুল্ক এসে ঠেকেছে ২০ শতাংশে। যা ভারতের চেয়েও ৫ শতাংশ কম। এটা একটা বিশাল সাফল্য। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের অঙ্কটা বিশাল। সে অনুযায়ী ভারতের প্রতি অনেক বেশি নমনীয় হওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের। আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যটা এখানেই। এটা অর্থনীতি শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও একটা উল্লেখযোগ্য বিজয়। 

এই ‘ডিল’টার সাথে মূল চরিত্রে যারা ছিলেন, তারাও বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদদের কাছে খুব একটা ‘ফোকাস্ড’ ছিলেন না। তাদের কাউকে নিয়ে কোনো কোনো মহলের বিতর্কও ছিল, কিন্তু যখন পরীক্ষা এলো তারা পাশ করে গেলেন। উপদেষ্টা ফারুকীকে নিয়েও বিতর্ক ছিল এবং আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার ক্ষেত্রে তিনি যে কাজ করে চলেছেন, তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক নেই। আর সেসব কাজ জুলাই বিপ্লবকে যোগ্যতার ভিত্তিতেই ধারণ করেছে। মানুষ না বুঝে, মানুষের কাজ না বুঝে বিতর্ক শুরু করাটা যে বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তা বুঝতে পারাটাই বুদ্ধিবৃত্তি। 

‘চেয়ার মেইক অ্যা মেন’ এই কথাটা প্রচলিত এবং সাথে কথাটা মিথ্যা। চেয়ার যদি ব্যক্তি তৈরি করতো তাহলে শেখ হাসিনা তার চেয়ারের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতেন। এত বড় উদাহরণ সমুখে থাকার পরও যারা বলেন, ‘চেয়ার মেইক অ্যা মেন’ তারা মূলত ‘ইউটোপিয়ান’। ‘ইউটোপিয়া’ আর যাই হোক কোনো কাজের বিষয় নয়। চেয়ার কোনো মানুষ তৈরি করতে পারে না, মানুষ মূলত চেয়ারকে মহিমান্বিত করে। না হলে অযোগ্যকে যোগ্য চেয়ার দিলে সেই চেয়ার কলুষিত হয়। আমাদের সমুখে এখনও এমন চেয়ার অসংখ্য রয়েছে, যেখানে অযোগ্য মানুষগুলো বসে আছে। ইন্টেরিম সরকারের কিছু ব্যর্থতার কারণ এই অযোগ্যতা। এই সরকারের সফলতা ম্লান হচ্ছে এসব অযোগ্যদের কারণ। যোগ্য লোক খুঁজে বের করা যেমন সাফল্য, তারচেয়ে বড় সাফল্য অযোগ্য লোক খুঁজে বের করার মধ্যে। 

ব্যর্থতার ব্যাপারে আসি, এই সরকারের ব্যর্থতায় কেউ যদি খুশি হন, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের পক্ষশক্তির কেউ, তাহলে সে বোকা। এই ব্যর্থতা আপনারও, কারণ আপনি এই সরকারকে গঠন করেছেন। যে কারণে জাতীয় সরকারের রিস্ক নিতে চায়নি রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ নেতারা জানতেন বিপ্লবোত্তর একটা দেশেকে সামলানো এত সহজ কথা নয়। একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতনের পর, যে ফ্যাসিস্ট রেজিমকে অন্তত দুটি পরাশক্তি সমর্থন জুগিয়েছে। যে সমর্থন কোনো নীতি-নৈতিকতার বাইরে অন্ধ-সমর্থন, সেখানে জাতীয় সরকার গঠন করে তার প্রধান হলে, কতদূর যাওয়া যাবে তা বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের রাজনীতিকরা। এই বুঝতে পারাটাও একটা প্রজ্ঞার ব্যাপার। বিপরীতে ইন্টেরিম কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে আনন্দে বগল বাজানো বোকামো। এবং জাতীয় সরকার গঠনে নিজেদের ব্যর্থতাটাকেই সেলিব্রেট করা। 

রাজনীতি দুটো টার্ম, শর্ট টার্ম এবং লং টার্ম। উদাহরণ দিই ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে গণমতের বিপরীতে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পায়নি, বসেছিল বিরোধী দলে এবং সে অবস্থানও খুব সম্মানজনক ছিল না। মাত্র চার বছর পরেই আওয়ামী লীগের পতন ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৯১ এর নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি, বিরোধী দলে ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৮৬ এর আওয়ামী লীগের শর্ট টার্মের রাজনীতি দলটিকে ১৯৯১-এ ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। কিন্তু বিএনপির পছন্দ ছিল লং টার্ম, তারা ১৯৯১-এ ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৯৬ এর নির্বাচনেও শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল দলটি। নির্বাচনের পর বিবিসির ভাষ্য এমনটা ছিল, ‘বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও জনগণ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেনি’। 

বিএনপির ২০০১-এ আবার ক্ষমতায় এসেছিল। এই হলো লং টার্ম রাজনীতির পজিটিভিটি। কিন্তু ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে বিএনপির রাজনীতির ধরণ কিছুটা পাল্টে গিয়েছিল। তাদের মাথাতেও হয়তো শর্ট টার্মের ভূত চেপেছিল এবং তার পরিণতিই দেড় দশকের বেশি সময় ধরে নির্যাতনের শিকার হওয়া। যা থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল ২০২৪ এর ৩৬ জুলাই। সুতরাং জুলাই বিপ্লবকে অস্বীকার করা মানে দেড় দশকের নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপারটিকে অস্বীকার করা, গুম-হত্যা, হামলা-মামলা সবকে অস্বীকার করা। এক কথায় নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। 

শর্ট টার্মের আওতায় সেই অস্বীকারের রাজনীতির প্রবণতা আবার দেখতে পাচ্ছি। ব্যর্থতাকে মোকাবিলার বদলে সেলিব্রেট করা হচ্ছে। আর সফলতাকে সেলিব্রেট না করে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। ইন্টেরিম এর সীমাবদ্ধতা অনেক, কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাকে সবাই মিলে কাটিয়ে তুলতে না পারলে সেই ব্যর্থতার দায় শোধ করতে হবে এদেশের রাজনীতিবিদ এবং গণমানুষকেই। ফ্যাসিস্ট রেজিমের পরিণতি নিয়ে যা লিখেছিলাম তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। বর্তমান রাজনীতির যে ধারাবাহিকতা তাতে খারাপ পরিণতির আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই ধারাবাহিকতা থেকে না বের হয়ে আসলে হয়তো অশুভ পরিণতির কথা আবার লিখতে হবে, যা আমি এবং আমার ধারণা কোনো সচেতন মানুষই চাইবেন না।

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন