মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: ঢাকার প্রাইমেসি কি তবুও কমবে না?

ড. ফয়সাল কবির শুভ
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:২৩ পিএম

গত বছরের জুলাই মাস ছিলো ফ্যাসিস্ট বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রক্তস্নাত একটা মাস। বছর ঘুরে সেই জুলাই মাস আবার তাজা প্রাণের রক্ত দেখালো এই জাতিকে। গতকাল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বহু কোমলমতি শিশুর প্রাণহানির যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে, তা গোটা জাতিকে শোকাহত করেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়েছে, এছাড়াও সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে প্রায় দেড়শ জনের মতো।
গতকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দূর্ঘটনা পরবর্তী যেসব ভয়ানক ও বীভৎস ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তা কল্পনার বাহিরে। কিন্তু যখন পুরো দেশ তার কোমলমতি কিছু তরতাজা প্রান হারিয়ে শোক পালন করছে, তখন এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের একটি গভীর ও অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আবার। আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়—বরং একটি ভয়ংকর সতর্কবার্তা। ঢাকা কেন্দ্রিক কর্মকান্ড বিকেন্দ্রীয়করন না করে এবং সেইসাথে এই শহরে পরিকল্পনার ন্যুনতম ছোয়া না লাগিয়ে শহরকে আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দূর্যোগের মুখোমুখি করে দিচ্ছি।
তিলোত্তমা ঢাকা যেন নিজেকেই সহ্য করতে পারছে না
প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ ঢাকায় বাস করে, কিন্তু এই শহরের পরিকাঠামো, পরিকল্পনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই তুলনায় প্রচন্ডভাবে দুর্বল। উত্তরার দুর্ঘটনায় আমরা দেখতে পারছি কীভাবে প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল করে এমন একটা আকাশপথে যার একেবারে নিচেই শিশুদের স্কুল চলে। শহরের ক্রমাগত ও অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণে নিরাপদ দূরত্বের ধারণাই যেনো বিলীন হয়ে গেছে। একসময়ের সুরক্ষিত বাফার জোনগুলো এখন উচ্চবহুতল ভবনে পরিণত হয়েছে। ফলে এই মেগাসিটির জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিভিন্ন সাংঘর্ষিক ভূমি ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঢাকার আকার বেড়ে যাওয়া এবং মোটের উপর ঢাকার প্রাইমেসি নিত্যনতুন মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি করছে। একেকটা দূর্যোগ মানে দেশের মানুষের জান এবং মালের ব্যপক ক্ষতিসাধন। শহরের দালান-কোঠা আর অবকাঠামোগত বিন্যাস দেখে যে কারো মনে হবে ঢাকা দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত আছে—শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ঢাকার বিকেন্দ্রীয়করন কি সম্ভবের বাহিরে কিছু?
ঢাকা শহর আমাদের প্রাণকেন্দ্র, তা ঠিক, কিন্তু এখন এই প্রাণকেন্দ্রই ভয়াবহভাবে সংকটাপন্ন। প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজধানীমুখী—চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা, সবই এখানে। ফলে এক শহরকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে সবকিছু: সরকার, সামরিক ঘাঁটি, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা এমনকি বিমানঘাঁটিও। প্রতিবার ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং ঢাকাতে ফেরত আসার যেসব প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরনের মাধ্যমে ঢাকার উপর চাপ কমানোর কথা অনেক আগে থেকে বলা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ এই বিকেন্দ্রীকরনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এতোকিছুর পরেও কেনো জানি- এই ব্যাপারটার ক্ষেত্রে কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ কোন রাজনৈতিক দল বা সরকার থেকেই নেয়া হয় না। যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সাথে বাংলাদেশের মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা জড়িত, সেইরকম একটা ডিসিশানের ব্যাপারে কেনো রাজনৈতিক ঐক্যমত হবে না তা বোধগোম্য হয় না।
ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এখন আর কেবল একটি প্রশাসনিক পরিভাষা নয়; এটি জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্ন। যদি আমরা সরকারি অফিসগুলো, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক ঘাঁটি ও প্রধান সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ বা খুলনার মতো আঞ্চলিক শহরগুলোয় ছড়িয়ে দিই, তবে ঢাকার ওপর থেকে চাপ অনেকটাই কমে যাবে। এমনকি বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান শাখাগুলো ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলো যেমন গাজিপুর, নরসিংদী বা টাংগাইলের মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। এই পরিবর্তন ঢাকাকে শুধু প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করবে না, বরং সমগ্র দেশকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ করে তুলবে। এক জায়গায় বড় ধাক্কা লাগলে পুরো দেশ যেন অচল না হয়ে পড়ে, সেই সক্ষমতাই গড়ে উঠবে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে।
পরিকল্পনার ঘাটতিই মৃত্যুর কারণ
ঢাকা শুধু বেড়ে ওঠেনি, বলতে গেলে তা একপ্রকার বিস্ফোরিত হয়েছে। কিন্তু এই বিস্তারের পেছনে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা ছিল না। যেখানে নিয়ম ছিল, সেখানে প্রয়োগ ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ও বসতিপ্রবণ এলাকা আলাদা করার মতো স্পষ্ট অঞ্চল নির্ধারণের অভাব ছিল, এবং এখনো আছে। স্কুল, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, দোকানপাট—সবই গাদাগাদি করে এক জায়গায়।
প্রশ্ন হচ্ছে: বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষন কেনো একটি ঘনবসতিপূর্ন এলাকায় হবে? কেন বিমানবাহিনীর ঘাটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রেই হতে হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা বারবার এড়িয়ে গেছি, আর এখন তার পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
এই শোকের মুহূর্ত আমাদের সামনে একটি সুযোগ তৈরি করেছে। মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের এই বেদনার ঘটনাকে আমরা যেন কেবল একটি ‘রুটিন এক্সিডেন্ট’ হিসেবে না দেখি। এটি যেন একটি মোড় পরিবর্তনের শুরু হয়।
আমাদের এই মুহূর্তে প্রয়োজন—
রাজউক প্রণীত বিমানঘাঁটি ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলোর চারপাশে জোনিং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ; যদি এই আইন যথাযথ না হয় তবে সেগুলো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা,
বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষনের পথ ঘনবসতিপূর্ন এলাকার বাহিরে করা;
ঝুঁকিভিত্তিক নগর পরিকল্পনা যাতে ভূ-তথ্য ও বাস্তবভিত্তিক ডেটা অন্তর্ভুক্ত থাকে;
উন্মুক্ত স্থান ও প্রশস্ত পথের পরিকল্পনা, যাতে জরুরি প্রয়োজনে তা ব্যবহৃত হতে পারে;
বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডের কঠোর বাস্তবায়ন।
উপরে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি আরেকটি গুরূত্বপূর্ন বিষয় হলো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সংকট মোকাবেলাতে আরো সক্ষমতা অর্জন করা দরকার সংশ্লিষ্ঠ সংস্থাগুলোর। সেই সাথে প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ও অফিসে বাধ্যতমূলক দূর্যোগ মোকাবেলার ট্রেনিং ও ফায়ার ড্রিল করা জরুরী। বিশেষ করে, স্কুলের পাঠ্যসুচি হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
এখনই সময় বদলের, এখনই সময় দায়িত্ব নেবার
রানা প্লাজা ধ্বসে পড়া, পুরাতন ঢাকার কেমিক্যাল স্টোরেজে আগুনসহ এইরকম অনেক দুর্ঘটনায় অতীতে অনেক প্রান হারিয়ে গেছে। একেকটা দূর্ঘটনা ঘটার পরেই আমরা কিছুদিনের মধ্যে সব ভুলে যাই। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের কান্না কোন দিন থামে না। তাই আমরা যেন এই বিমান বিধ্বস্ত হবার দুর্ঘটনা ভুলে না যাই। একদিনের শোক কিংবা একটি তদন্ত রিপোর্টের মধ্যেই যেন এই ঘটনার পরিসমাপ্তি না ঘটে। আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা, আমাদের নগরের বাসযোগ্যতা ও আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ-- সবকিছুর প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।
ঢাকা আর একা এই জাতির সব ভার বহন করতে পারবে না। এখনই সময় সারাদেশকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে নতুন করে গড়ার-- পরিকল্পিত, নিরাপদ এবং মানবিকভাবে। মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের যেসব নিষ্পাপ প্রাণ আমরা হারিয়েছি, তাদের জীবন যেন আমাদের ঘুম ভাঙায়—এবং জাগিয়ে তোলে একটি সাহসী, সুশাসিত ও সুপরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ার সংকল্প।
লেখক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সিডনী ওয়াটারে কর্মরত।