
কারফিউ চলছে। সুনসান নীরবতা গোপালগঞ্জে।
‘একটা হোস্টাইল জায়গায় যাইতে হইবো কেন?’ প্রশ্নটা ভ্যালিড। ভ্যালিড সেই ক্ষেত্রে যেই ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রশ্ন নাই, আছে ক্রিমিনোলজির প্রশ্ন। জিম্মি বা অপহরণের মতন ঘটনার ক্ষেত্রে কিংবা ডাকাতদলের সাথে বন্দুকযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সেই জায়গায় যাওয়ার প্রশ্নে। কিংবা চরদখল নিয়ে দুই দলের টেটাযুদ্ধকালীন এলাকায়। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে হোস্টাইল শব্দটা যখন ব্যবহৃত হয়, তখন যে পক্ষের জন্য ব্যবহার করা হয়, তা রাজনৈতিক পক্ষ থাকে না, অপরাধী হয়ে ওঠে। সুতরাং, হোস্টাইল শব্দটা ব্যবহারের আগে একটু চিন্তা করা উচিত।
এখন আসি ‘যাওয়া না যাওয়া’র প্রশ্নে। ‘এনসিপি গোপালগঞ্জে যাবে কেন? প্রস্তুতি নেয় নাই কেন?’ দুটো প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক। এখন তাহলে প্রশ্ন করি, কাল ভোট হলে এনসিপি বা অন্য কোনো দল কি গোপালগঞ্জে ভোট চাইতে যাবে না? তখন কি বলবেন, প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে! প্রস্তুতিটা কেমন, যুদ্ধের? আজকের দিন থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কালে ফিরে যাই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও একসময় গোপালগঞ্জে মঞ্চ করেও সভা করতে পারেননি। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে তাকে ফিরতে হয়েছে। ১৯৭৮ সালের কথা এটি। এরপর অবশ্য তিনি গোপালগঞ্জে কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন এরশাদও। তিনিও সভা করতে পারেননি। তাকেও হেলিকপ্টারের সহায়তা নিতে হয়েছে। তবে কি গোপালগঞ্জ বাংলাদেশ থেকে কোনো আলাদা রাষ্ট্র? সেখানে কি একটি দল ছাড়া কারো সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই? কদিন আগে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের গাড়িবহরে হামলা চালানো হলো। নিহত হলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা দিদার। তারাও রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই গোপালগঞ্জ আসছিলেন। এসব ঘটনায় কেউ যদি মুখ ফসকে বলে ফেলেন, গোপালগঞ্জ মূলত একদলীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাসী তাহলে তাকে খুব দোষ দেয়া যাবে কি?
কেউ বলেছেন, এনসিপি উস্কানি দিতে গেছে। কিংবা সেখানে গিয়ে উস্কানি দিয়েছে। কথাটা অত্যন্ত হাস্যকর। এর জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিল না, তবু দিই। কথাটা মূলত ফ্যাসিস্টদের উচ্চারিত শব্দের প্রতিধ্বনি। এই কথা সত্য হলে কোটা আন্দোলন থেকে একদফায় যাওয়া তো উস্কানি। জুলাই বিপ্লব তো আরও বড় উস্কানি। যারা উস্কানির কথা বলেন, বিপ্লব ব্যর্থ হলে তারা বলতেন, ‘কোটাই তো ঠিক ছিল, একদফায় যাওয়াটা ছিল উস্কানি। এই উস্কানি দিতে গিয়েই দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।’ হ্যাঁ, এমন কথাই তারা বলতেন ফ্যাসিস্টদের দরবারে গিয়ে কিংবা দরবারে যাওয়ার প্রত্যাশায়। বুদ্ধিজীবীরা কলাম লিখতেন, ‘যেভাবে দমন করা হলো রাজনৈতিক সন্ত্রাস’। বিপ্লব ব্যর্থ হলে তাই হতো। বিশেষ করে, আজকে যারা এপিসি করে, এনসিপি নেতাদের উদ্ধার দৃশ্য দেখে ট্রল করার চেষ্টা করছেন, তারা সবার আগে ফ্যাসিস্টদের দরবারে গিয়ে হাজির হতেন। একটা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাধা দিতে যে সশস্ত্র মব, সেই মব এই লোকদের চোখে পড়ে না, রামগরুড়ের চোখ যায় শুধু এপিসির দিকে। এদের কেউ কেউ আবার এপিসিকে ট্যাংক বললেন। এরা যেমন এপিসি আর ট্যাংকের পার্থক্য বোঝে না, তেমনি বোঝে না রাজনৈতিক কর্মসূচি আর সশস্ত্র সন্ত্রাসের পার্থক্য।
‘মব’-এর আলাপ তুলি। বেশ কিছুদিন ধরেই কথায় কথায় মব শব্দটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। জানি না যারা ব্যবহার করছেন, তারা মূলত মবের মানে জানেন কিনা। তারা জানেন কিনা, কী কারণে এবং কীভাবে মব তৈরি হয়। কতক গণমাধ্যমেও দেখছি মব নিয়ে ‘মববাজি’। তাদের মব বিষয়ে জ্ঞান না দিয়ে, অবশ্য উলুবনে মুক্তা ছড়াতেও নেই, প্রশ্ন করতে চাই, গোপালগঞ্জের ঘটনাকে কী বলবেন, এটা কি মব নয়? নাকি সেই আওয়ামী লীগের বাসে আগুন দিয়ে এগারোজন মানুষ হত্যাকে আন্দোলন স্বীকৃতি দিয়ে বলবেন, ‘ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’। বিপরীতে বিএনপির আন্দোলনকে বলবেন, ‘আগুন সন্ত্রাস’। যাহোক, তাও মব নিয়ে দু’কথা বলি। মবের দুটি রূপ। একটি মব-ভায়োলেন্স, অন্যটি মব-জাস্টিস। মব-ভায়োলেন্স হলো লজিকলেস, যা আজকে দেখা গেল গোপালগঞ্জে। আর মব-জাস্টিস হলো বিচারে বিলম্ব কিংবা বিঘ্নিত হবার আশঙ্কায় মানুষের নিজ হাতে বিচার তুলে নিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া। দুটো মবই খারাপ। খারাপটা যদি লজিকলেস হয় তাহলে তা বিপজ্জনক। মব-ভায়োলেন্স বিপজ্জনক।
‘গণ-কেইস’ বুদ্ধিজীবীদের কথায় আসি। এনাদের অনেকেই অতীতে বাম ছিলেন, মাঝে ফ্যাসিস্টদের ‘জাস্টিফায়ার’, ওই যে ‘ওনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে’ টাইপ। আর শেষে এসে কুসুম-কুসুম অ্যাক্টিভিস্ট। তারা গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে কুসুম-কুসুম সুরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে দাবি করছেন। সকল মৃত্যুই বেদনার। কোনো মৃত্যুই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু গোপালগঞ্জের চার মৃত্যুর খবরের পর এই কুসুম-কুসুম বুদ্ধিজীবীরা নড়েচড়ে বসেছেন। তাদের মানবাধিকার বোধ জেগে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জলের মৃত্যুর পর তাদের সর্বশেষ মানবাধিকার বোধ জাগতে দেখেছিলাম। যাত্রাবাড়িতে পাখির মতন মানুষ মারার দৃশ্যে তাদের বোধ জাগেনি। লাশের স্তূপ গাড়িতে রেখে জ্বালিয়ে দেবার দৃশ্যও তাদের বোধের ‘ইয়ে’ দাঁড় করাতে পারেনি, এরা এখন বোধের আলাপ পাতেন, করেন মানবাধিকারের গল্প। বলিহারি। যাকগে, বাদ দিই। এদের নিয়ে কথা বলতে গেলে রুচিবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় নিজের কর্তব্যবোধও।
জুলাই বিপ্লব হয়েছে জান ও জবানের স্বাধীনতার জন্য। গোপালগঞ্জে কথা বলতে গিয়েছিল এনসিপি নেতৃবৃন্দ, তাদের জবান রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে, জানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশের পতিত রাজনীতিকে উত্তরণের একটা পথই হচ্ছে জান-জবানের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। এটা যারা বিঘ্নিত করতে চাইবে তারা সবাই ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিজম তাদের রক্তে।