
বিএনপির লোগো
২০১৪ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনে না যাওয়ার স্বিদ্ধান্ত নিলেন। চারিদিকে সমালোচনা। বিএনপি বড় ধরনের ভুল করল। টক শো থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র একই রব। গেল রে গল! বিএনপি গেল! মানে বিএনপি শেষ! ২০০৮ এর নির্বাচনে ২৯ সিট পাইছে আর এইবার তো নির্বাচনেই নাই!
বিশেষ করে সুশীল সমাজ বলে পরিচিত সমাজের এলিট শ্রেণির লোকজন বলতে লাগল চার চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের পর নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি আত্মহত্যা করল! কিন্তু খালেদা জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনার কূটচাল এবং এটাও জানতেন একটা দলের রাজনীতি কয়েক বছরের জন্য নয়; বরং আদর্শিক রাজনীতির আয়ুষ্ককাল যুগ যুগ ধরে।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ একপেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা খুব সচেতনভাবে বাতিল করেন শেখ হাসিনা। যেন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যায়। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের নজীর নেই বাংলাদেশে। সবকিছু কুক্ষিগত থাকে সরকারের হাতে! বেগম খালেদা জিয়া জানতেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, বিএনপি নিশ্চিত জিতবে! কিন্তু শেখ হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিকভাবে একতরফা নির্বাচন করলেন এবং ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হল! খালেদা জিয়াকে বালুর ট্রাক দিয়ে শত শত পুলিশ দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলা হল। তখনও এক শ্রেণির সুশীল ভাই বোনেরা হাসিনার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন! টক শো বলেন কিংবা হাসিনার দাওয়াতের কোনো অনুষ্ঠান, প্রেস কনফারেন্স হয়ে উঠত এক রঙ্গশালা। কিছু কিছু বুদ্ধিজীবীরা যে ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়! কিন্তু সংখ্যা ছিল খুব সীমিত। তাদের সীমিত ভয়েস আওয়ামী সুশীলদের হুংকারের তুলনায় খুবই ম্রীয়মান ছিল।
ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করল, খালেদা জিয়া জেলে! বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। তারপরও বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে চরম ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনে গেল। কিন্তু নুরুল হুদা কমিশন দিনের ভোট রাতে করে ফেলল। কিন্তু সুশীলদের কি ভূমিকা ছিল!! তখনও এক শ্রেণির সুশীল বলা শুরু করল বিএনপির মাটি কামড় দিয়ে পড়ে থাকা উচিত ছিল, বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে, বিএনপির কোনো গেইম প্ল্যান নেই, বিএনপির কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, বিএনপি একটি ক্লাব, আমাদের একটি শক্তিশালী বিরোধীদল দরকার ইত্যাদি, ইত্যাদি।
২০২৪ এর নির্বাচন। বিএনপি ছাড় দিতে চাইল। সংলাপ করতে চাইল। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত খুব চেষ্টা করলেন আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসাতে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের বললেন, সময় শেষ! বিএনপির ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের জনসভাকে কেন্দ্র করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির প্রায় সব সদস্য এবং জেলা উপজেলার তৃণমূলের নেতাকর্মী কাউকে বাদ রাখেনি জেলে নেওয়ার জন্য। কিংস পার্টি গঠন করল। তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম। আমি আর ডামির খেলা খেলল। তখনও সুশীলরা বললেন বিএনপি ২৮ অক্টোবর পরাজিত হয়েছে। এই বিএনপি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
এখন এই ২০২৫ এ এসেও সমস্ত অভিযোগ বিএনপির বিরুদ্ধে। গত ১৭ বছর ধরে বিএনপি শুধু আওয়ামী নিষ্পেষণ সহ্য করেনি, সহ্য করতে হয়েছে সুশীল নির্যাতনও! আওয়ামী সুশীল বাদেও কিছু তথাকথিত নিওট্রাল সুশীলদেরকেও ফেইস করতে হয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত স্বৈরাচারী হাসিনার আস্ফালনকে জয় হিসেবে দেখত। আর সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা চরমভাবে নিপীড়িত, নির্যাতিত বিএনপিকে দেখত পরাজিত হিসেবে।
একটি রাজনৈতিক দলের স্থায়িত্ব কত দিনের। ১৫/২০ বছর যাচ্ছেতাইভাবে ক্ষমতায় থেকে পরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। গণধিকৃত দলে পরিণত হওয়া! বেগম খালেদা জিয়ার চিন্তায় ছিল, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত বিএনপিকে বহুদূর যেতে। দেশের সার্বিক মঙ্গল বিএনপির হাত ধরেই হবে। তাই তিনি যেনতেন নির্বাচন বয়কট করেছেন। নিজে জেল খেটেছেন প্রচন্ড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সুস্থ অবস্থায় হেঁটে হেঁটে জেলে গেছেন, কিন্তু ফিরেছেন চরম অসুস্থ হয়ে।
কেন? শুধুমাত্র গণতন্ত্রের জন্য! চাইলেতো তিনি ২০১৮ সালেও আপোস করতে পারতেন হাসিনার সাথে অথবা হাসিনার মতো পলায়নও করতে পারতেন! কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের নেত্রী। নিজের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও জেলে যাওয়ার আগে নির্বাহী কমিটির সভায় বলে গেলেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে।
বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশের বুদ্ধিজীবী দীর্ঘ দিন ধরেই প্রো আওয়ামী লীগ ছিল। এর কোনো স্পেসিফিক কারণ নেই! বিএনপির ভালো কাজগুলো কখনই তাদের চোখে পড়ত না। আর আওয়ামী লীগের চরম অন্যায়টাও এড়িয়ে যেত। ইনিয়ে বিনিয়ে আওয়ামী লীগকে ডিফেন্ড করত।
বুদ্ধিজীবীরা সমাজের বিবেক হিসেবে কাজ করা উচিত। একটা ঘটনা ঘটলে তার কার্যকারণ যাচাই করে কথা বলা উচিত। অনেক সময় একটা ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তড়িৎ মন্তব্য জনপরিসরে ভুল ধারণার উদ্রেক করে। এটা ঠিক ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সুশীল সমাজের এক বিরাট অংশ হাসিনার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছে যা সচেতনভাবেই তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু জনপ্রিয় লেখক ছাত্র-ছাত্রীদের “আমি কে, তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার” স্লোগানকে খারাপ চোখে দেখেছে, লিখেছে পত্রিকায়। কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে এই স্লোগান এল এবং এরও পরে হাসিনার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ঐসব বুদ্ধিজীবীদের পাওয়া যায়নি।
এখনও কিছু কিছু গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে বিএনপির ৩১ দফার সমালোচনায়। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিএনপি কোনো দল যারা ভিশন ২০৩০ এর মাধ্যমে ২০২২ সালেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছে। তখন কিন্তু আজকের সুশীল ভাইয়েরা ছিলেন না। কারণ তখন হাসিনার নিয়ন্ত্রিত কারাগার ছিল দেশটা। বিএনপি সংস্কার কমিশনের কথা বলেছে, একটি সুলিখিত এবং কার্যকরী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দিয়েছে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল। তখন কিন্তু আজকের নব্য সুশীল ভাইয়েরা ছিলেন না। কারণ তখন সংস্কারের কথা তো দূরে থাক, হাসিনার বিরুদ্ধে একটা সাধারণ কথা বললেও মামলা জুটে যেত। তখন আজকের নব্য সুশীল ভাইদের কোনো প্রস্তাবনা ছিল না।
এখন নব্য সুশীল ভাইয়েরা বিএনপিকে অনেক জ্ঞান দিচ্ছেন; বিএনপির এটা করা উচিত নইলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি হবে। এই দেশ আর সেই দেশ নাই.. পিআর মেনে নিতে হবে। তখনও একই রকম কথা হত, তখনকার সুশীল ছিল অন্যরা।
এটা সত্য বিএনপিকে অবশ্যই নিজের দলটাকেও সংস্কারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যত প্রোপাগান্ডা বিএনপির বিরুদ্ধে তার একটি সৎ অনুসন্ধান করে কার্যকরী Disciplinary Action নিতে হবে। এবং দীর্ঘ মেয়াদে দলকে সুসংহত করার জন্য দলে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। তরুণদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেহেতু তরুণরা বাংলাদেশের জনগণের একটি বিরাট অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে তাই তাদেরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, তাদের মনস্তত্ত্বকে হৃদয়ঙ্গম করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবেই একটি জনআকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাব আমরা। আর তখন সুশীল সমাজের বয়ানও একপাক্ষিক না হয়ে বাস্তবিক হবে।
প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
www.engr-salahuddin.com