
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, জুলাই নিয়ে অনেকেই খুব একটা কথা বলতে চান না, যতটা বলেন নির্বাচন নিয়ে। যতটা বলেন, জুলাই যোদ্ধাদের চরিত্রহননের নিমিত্তে। তাদের মারমুখো অবস্থান দেখে মনে হয় জুলাই যোদ্ধারা ক্রমেই তাদের রাইভাল হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে জুলাই যোদ্ধাদের একটি অংশ রাজনৈতিক দল গঠনের পর এই প্রক্রিয়াটি রীতিমতো উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। অনেকে তো আওয়ামী লীগের চেয়েও জুলাই যোদ্ধাদের বেশি শত্রুজ্ঞান করছেন। অথচ প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো এই জুলাই যোদ্ধারা না থাকলে আজও ক্ষমতায় থাকতো আওয়ামী রেজিম। ২০৪১ সাল পর্যন্ত সুদূর পরাহত থাকতো কারো কারো ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন। এটা তারা অস্বীকার করলেও আমজনতা এই সত্যটা জানে। আমজনতা এটাও জানে জুলাই যোদ্ধাদের রাইভাল মনে করে করার কারণ হলো ব্যর্থতা। জুলাই বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির ব্যর্থতার স্মারক। রাজনীতিকদের ব্যর্থতার স্মারক। ব্যর্থতা থেকেই ঈর্ষা। আর ঈর্ষা থেকেই জুলাই ও জুলাই যোদ্ধাদের অস্বীকার করার প্রবণতা। বলতে পারেন নার্ভাস রিয়েকশন।
৩৬ জুলাই, ৫ আগস্ট। সকাল আটটা। মোবাইল বেজে উঠলো। ধরলাম। একটি দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার ফোন। বললেন, ‘পোলাপান কী করতে পারবে। আমরা এত চেষ্টা করলাম এতদিন ধরে, কিছু করতে পারলাম না।’ আরো বললেন, ‘দেখেন, ঢাকায় সবই ঠান্ডা। তেমন কোনো গ্যাদারিং নাই। কিছুই হবে না ভাই। আপনারা অহেতুক আশা নিয়ে বসে আছেন।’ আমিও দ্বিধান্বিত। সকাল আটটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে জড়ো হতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশ নির্বিচারে রাবার বুলেট ছুড়েছে। সকালে কোথাও তেমন জমায়েত নেই। কিছুটা হতাশা সত্যিকার অর্থেই ভর করেছিল। কিন্তু দশটার পর থেকে খবর আসতে থাকে চারিদিক থেকে, মানুষ পথে নেমেছে। এগারোটার মধ্যে অগণিত মানুষ পথে নামে। গৃহিণী থেকে রিকশাওয়ালা। চাকুরিজীবী থেকে রাস্তার হকার। সবাই নেমে আসে পথে। নেমে আসে জেনারেশন জেড এর তরুণদের মৃত্যুঞ্জয়ী নেতৃত্বে। এখানে কোনো রাজনীতি ছিল না, ছিল না কোনো দলের হেভিওয়েট নেতা। ছিল জেনারেশন জেড এবং তার নেতৃত্বে আপামর সাধারণ মানুষ। এবং ফ্যাসিস্ট রেজিমকে পরাজিত করার অদম্য ইচ্ছা। জুলাই বিপ্লবের যতগুলি দৃশ্যচিত্র পাওয়া যায়, তার একটাতেও সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারবে না কেউ। সুতরাং জুলাই প্রকৃতভাবেই কারো কারো ব্যর্থতার স্মারকচিহ্ন।
জুলাই নিয়ে অনেক বুড়ো নেতাদের হতাশা কাজ করে। আগেই বলেছি, হতাশা থেকেই ঈর্ষা। অথচ জুলাই তাদের আজকের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে। জেলখানা ছেড়ে তারা যমুনায় বসার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা ঈর্ষার অন্ধত্বে জলাইয়ের দৃশ্যচিত্র দেখতে পাচ্ছেন না। মগজের বন্ধ্যাত্বে বুঝতে পারছেন না, জুলাই তাদের মুক্তির সনদ লিখেছে। তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে জুলাই বিপ্লব। অথচ সেই জুলাই সনদেই তাদের আপত্তি! তারা দেশের সাধারণ মানুষের পালস বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন ক্রমশ। তাদের অন্ধত্ব ও বন্ধ্যাত্ব যদি দূর না হয় তাদের পরিণতিও সুখকর হবে না। রাষ্ট্রক্ষমতাও তাদের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। অন্ধত্বের দরুন কথাগুলো বিশ্বাস না হতে পারে, কিন্তু অপেক্ষা করুন সময়ই তা নিশ্চিত করবে।
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, আমরা কীভাবে জুলাইকে অস্বীকার করবো। জুলাই আমাদের শত্রুমিত্র চিনতে শিখিয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় শত্রু, রাজনৈতিক শত্রু, অর্থনৈতিক শত্রু এমনকি সামাজিক শত্রুও চিহ্নিত করে দিয়েছে জুলাই। আজকে আমরা জানি আমাদের রাষ্ট্রীয় শত্রু কোন দেশ। আমরা জানি আমাদের রাজনৈতিক শত্রু কারা। আমাদের অর্থনৈতিক শত্রু কোন কোন গোষ্ঠী। এমনকি আমাদের সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে রেখেছে কোন কোন সামাজিক শত্রু।
এখন আমরা জানি, কোন দেশ আমাদের বিগত নির্বাচনগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। কোন দেশ মাত্র একটি দলকে সমর্থন করেছে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে। কোন দেশ আমার দেশকে রক্ষিতার মতন ব্যবহার করতে চেয়েছে। আমরা জানি, কোন কোন দল রাজনৈতিক ভাবে আমাদের জান-জবানের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন দল আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। নানান কৌশলে আমাদের একটি দেশের উপর নির্ভরশীল করে রেখেছিল। বিপরীতে তারা দেশটাকে লুটের মাল হিসেবে ধরে নিয়েছিল। আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি আমাদের অর্থনৈতিক শত্রুদের। অলিগার্কদের। যে অলিগার্করা দেশটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে নিজেরা মোটাতাজা হয়েছে। বিদেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ করেছে। আমরা চিনেছি আমাদের সামাজিক শত্রুদের, যারা আমাদের ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে বিভাজিত করে রেখেছিল। সুশীল নামের এসব আয়নাবাজদের চেনা হয়েছে জুলাইয়ের কল্যাণেই।
সমস্যা যখন চিহ্নিত হয় তখন সমাধান যেমন সহজ হয়, তেমনি শত্রু চিহ্নিত হওয়া মানে যুদ্ধ জয়ের প্রথম ধাপ। আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যেই আছি। জুলাই বিপ্লব চলমান। চলমান না হলে এ এমন লেখা লিখতে হতো না আমাকে। জুলাইকে ধারণ করার, রক্ষা করার আকুতি জানাতে হতো না। বিপ্লব সফল হয়েছে, কিন্তু বিপ্লবী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই বিপ্লব চলমান। সাফল্য আর সার্থকতার মধ্যে যে ফারাক তা বুঝতে হলে জুলাই বিপ্লবের ধাপগুলোকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থার সাথে আমাদের বিপ্লব পরবর্তী অবস্থার পার্থক্য। বিপ্লব পরবর্তী বিপ্লবের সুবিধাভোগী কারা হতে যাচ্ছে কিংবা হয়েছে তা অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে বিপ্লবে যারা ছিলেন না, যারা ছিলেন ফ্যাসিস্টদের নির্যাতনের শিকার, তারা জুলাই বিপ্লবের কল্যাণে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাদের কেউ কেউ আবার মজলুম থেকে ক্রমেই জালিম হয়ে ওঠার চেষ্টায় রত রয়েছেন। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ফ্যাসিস্টদের সহযোগী শক্তিগুলো। একেবারে জর্জ অরওয়েল এর আলোচিত উপন্যাস অ্যানিমেল ফার্ম এর চিত্ররূপ হয়ে উঠছেন তারা। সুতরাং বিপ্লব চলমান এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও। বিপ্লব তখনই সফল থেকে সার্থক হবে যখন আমরা এই গোষ্ঠীটিকে পরাজিত করতে পারবো। সুতরাং সে পর্যন্ত চলবে বিপ্লব। আমাদের তরুণরা আমাদের আশার আলো, আমাদের পাথ-ফাইন্ডার। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।