Logo
Logo
×

অভিমত

জুলাই গণঅভ্যুত্থান — প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১১:১৫ পিএম

জুলাই গণঅভ্যুত্থান — প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ ই আগস্ট(৩৬ জুলাই) ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের মানুষের মানসপটে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা, জনগণকে প্রজা মনে করে নিষ্পেষিত করা, বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অবর্ণনীয় লুটপাট, রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক ডাকাতি, গুম -হত্যা-বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিজেকে এবং নিজের প্রয়াত পিতাকে দেশের রাজার আসনে অধিষ্ঠিত করা, একের পর এক নীল নকশাময় (২০১৪ সালে বিনা ভোটে ১৫৪ জন নির্বাচিত, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে, ২০২৪ সালে আমি আর ডামি) নির্বাচন করা— এত সব অপকর্মের বিস্ফোরণ হচ্ছে জুলাইয়ের এই ৩৬ দিনের আন্দোলন।

কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই আন্দোলন রূপ নেয় গণ আন্দোলনে এবং এর প্রাপ্তি আসে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে। ১ জুলাই থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলন বেগবান করতে থাকে।৪ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “কোটা কখনো মেধার বিকল্প হতে পারে না”। ৬ জুলাই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের দাবিকে যৌক্তিক বলেন এবং সমর্থন জানান। বিএনপি প্রথম থেকেই এই আন্দোলনে নিজেদেরকে একটু বুদ্ধিমত্তার সাথে সংযুক্ত রেখেছে এবং পেছন থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে — কারণ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার যেকোনো ধরনের আন্দোলন হলেই সেটাকে বিএনপি নিধনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। বিএনপির অগণিত নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলা দিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানি করত। এ জন্যই বিএনপি নেতৃত্ব খুবই সচেতনভাবে জুলাই আন্দোলনকে নিজেদের দিক থেকে সতর্কতার  সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যেন সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো যায়।

জুলাই আন্দোলনের  একটা বিরাট উত্থান হয় ১৪ তারিখে — যখন সাংবাদিক প্রভাষ আমিন ও ফারজানা রুপার প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা  পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?”। এই অবমাননাকর মন্তব্য তরুণ প্রজন্মকে  চরম বিক্ষুব্ধ করে তোলে। গত ১৬ বছর ধরেই,  কোন ছোট একটা ঘটনা ঘটলেই,  যে কাউকে রাজাকার ট্যাগ দেওয়া ছিল আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ছাত্র-ছাত্রীরা রাতেই “ তুমি কে, আমি কে- রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে,  কে বলেছে- স্বৈরাচার,  স্বৈরাচার “ স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরম প্রতিক্রিয়া দেখায়।

১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ কে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে এবং চট্টগ্রামে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ওয়াসিম সহ আরও ৬ জনকে হত্যা করে আওয়ামী সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য আন্দোলনকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা করতে থাকে। আবু সাঈদকে সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী সরকার মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে ফেলে! প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য ঠিক একইরকম ভাবে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রদল নেতা জনিকে অসংখ্য গুলি করে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়। জনির স্ত্রী একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে কেঁদে কেঁদে প্রশ্ন করেছিলেন” একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি লাগে?”।  এরকম অগণিত নির্মম, পাশবিক  ঘটনার জন্মদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা।

এখানে উল্লেখ করতেই হবে ১৬ তারিখের পর থেকেই মানুষের মানসপটে এবং জনপরিসরে এই আলাপ চলতেই থাকে — শেখ হাসিনাকে সরে যেতে। শেখ হাসিনা তখন মানুষের কাছে একজন অসহ্য দানবে পরিণত হয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে এই আন্দোলন শুরু হলেও এর ব্যাক এন্ডে সবসময়ই ছাত্রদল সহ অপরাপর ছাত্রসংগঠনগুলো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে নিখোঁজ(গুম) হন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নাহিদ,আসিফ সহ চার সমন্বয়ক।

প্রথম দিকে কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন খুব  অল্প সময়ের মধ্যেই সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার মূল কারণ—অপরিসীম বঞ্চনা ও অবজ্ঞা। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে;  সেটা সুশীল সমাজ হোক কিংবা সাধারণ মানুষ হোক, যে পরিমাণ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, ভোট দেওয়ার মত অধিকার থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত রেখেছে— ৫৪ বছরের বাংলাদেশে উনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর অন্য কোন শাসকই এই কাজ করেনি।

তাই  একটা পর্যায়ে  আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য বা প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনার পতন। ১৯ জুলাই যখন ৯ দফা দেওয়া হয়, আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কিন্তু হাসনাত, সারজিসসহ অপর তিনজন সমন্বয়ক আনিসুল হক সহ সরকারের  তিনজন মন্ত্রীর সাথে দেখা করে দাবিকে ৮ দফায় নামিয়ে নিয়ে আসে।

কিন্তু জনগণ তখন ১ দফার জন্য প্রস্তুত। ১৯ জুলাই কারফিউ জারি হয়। কিন্তু আন্দোলন চলতে থাকে। একই সাথে পাল্লা দিয়ে  গুলি আর খুন চলতে থাকে। বিএনপি’র  ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিনিয়ত অনলাইনে ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন এবং অফলাইনে ছাত্রদল,  যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন কীভাবে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

জুলাই আন্দোলনে কেন গণমানুষ সম্পৃক্ত হল?

মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। যেকোনো একটা ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেই হাসিনা সরকার সেই আন্দোলনকে বিএনপির দেশবিরোধী তৎপরতা বলে চালিয়ে দিত। মৌলিক অধিকার শূণ্যের কোঠায় চলে এসেছিল। সংবাদ মাধ্যমগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এর ভয়ে ঠিকভাবে কাজ করতে পারত না। শেখ হাসিনার বিদেশ সফর নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনগুলোতে তার অনুগত সাংবাদিকদের তোষামদিতে বোঝা যেত এদের রুচি কতটা নিম্নপর্যায়ে চলে গিয়েছিল! দুর্নীতি লুটপাট চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বিশেষ করে একের পর এক কলুষিত নির্বাচন, ভোট দিতে না পারার বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা —মানুষকে এই আন্দোলনে যুক্ত হতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যোগায়।

কে ছিল না এই আন্দোলনে—কোন পেশার মানুষ ছিল না— কোন ধর্মের মানুষ ছিল না। সনাতন ধর্মের মানুষ থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালার পর্যন্ত এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে — একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে— শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। স্বৈরতন্ত্র থেকে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

জুলাই আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ  তারিখ ৩ আগস্ট। এদিন শহীদ মিনার থেকে এক দফা ঘোষণা করা হয়। সর্বস্তরের জনতার সামনে নাহিদ ইসলাম ১ দফা ঘোষণা করেন।সর্বাত্মক  অসহযোগ এবং  ৬ আগস্ট “মার্চ টু ঢাকা” ঘোষণা করা হয়। কিন্তু প্রখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরেরে ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়, নাহিদ ইসলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে কথা বলে, পরামর্শ  করে  “মার্চ টু ঢাকা” একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট(৩৬ জুলাই) নিয়ে আসেন। আসিফ মাহমুদ ৪ আগস্ট অনলাইনে এই ঘোষণা দেন।

জনতার স্রোত যখন ঢাকামুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা যখন ঢাকার দিকে ছুটছেন তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য,অগণিত মানুষের  হত্যার বিচার চাওয়ার জন্যে; শেখ হাসিনা তখন তার বোনকে নিয়ে পলায়ন করলেন পার্শ্ববর্তী দেশে। মানুষের আনন্দের বাঁধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে!

প্রাপ্তি কি?

প্রাথমিক প্রাপ্তি ছিল দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি। এটা সম্পূর্ণ সঠিক ১৯৭১, ১৯৯০ সালের পর বাংলাদেশের মানুষ আবার সবাই মিলে আনন্দ করার, উৎসব করার একটি দিন পায় ৫ আগস্ট(৩৬ জুলাই)। শেখ হাসিনা নামক এক ফ্যাসিস্টের হাতে জিম্মি বাংলাদেশকে মুক্ত করা ছিল এই ৫ আগস্টের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

গণতান্ত্রিক রূপান্তর কী হয়েছে?

শেখ হাসিনার পলায়নের পর স্বাভাবিকভাবেই দেশে একটা অস্থিরতা চলছিল। তখন বিএনপি সহ যুগপৎ আন্দোলনের সহযোগী দলগুলো এবং ছাত্র-জনতা একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের( Democratic Transition) উপর জোর দেন। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিএনপি সহ অপরাপর দলগুলো এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের ব্যাপারে কোন শর্তারোপ করেনি— বরং বরাবরই বলে এসেছে, ভগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু সরকার গঠনের পর থেকেই মানুষের দাবি-দাওয়ার হিড়িক পড়তে থাকে, শাহবাগের রাস্তা দখল করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আল্টিমেটাম চলতে থাকে! অটোরিক্সাওয়ালা, প্রাথমিক শিক্ষকেরা, নার্সরা,আনসার, তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা সবাই যার যার মত দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় চলে আসে। সরকারও যারপরনাই চেষ্টা করে, আশ্বাস দেয় তাদের সমস্যা দূরীভূত করার।

কিন্তু সরকার যেই কাজটা করতে সবচেয়ে দেরি করছে, তা হচ্ছ বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক পথে চলতে দেয়া!  ফ্যাসিস্ট হাসিনাসহ দেশ ধ্বংসকারী আওয়ামি লীগের বিচার করতে দেরি করা! শহীদদের তালিকা, আহতদের তালিকা সঠিকভাবে করতে না পারা!!

এজন্য একটি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটা কমিশনে বিএনপি সহ অন্যান্য দলগুলো অংশগ্রহণ করেছে, মতামত দিয়েছে। সেই কমিশনগুলোর প্রধানদেরকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে, সেখানেও বিএনপি সহ যুগপৎ শরিকরা তাদের মতামত দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করছেন। 

তাই মোটা দাগে প্রাপ্তি বলতে এই। কিন্তু অস্থিরতা কি এখনও থেমে আছে? কয়েকদিন আগেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড( এন বি আর) অচল হয়ে পড়ে রইল কয়েক দিন। ব্যবসায়ীরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে রাজস্ব বোর্ড চালু করার ব্যবস্থা করলেন।

তাই সরকারকে বুঝতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্রকৃত মিলন বিন্দু টা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এবং তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্মোহভাবে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে।

না হলে তা হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া অগণিত শহীদের সাথে নির্মম প্রতারণা।

প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান

www.engr.salahuddin.com

[email protected]

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন