শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বড় একটা অভিযোগ হলো, তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি কিংবা অংশগ্রহণ করেননি বলেই ক্ষমতা গ্রহণের পর মুজিবনগরে কখনো যান নাই। মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে তেমন কোনো কথা বলেন নাই। বলা যায়, তার মুখ থেকে মুজিবনগরের স্বীকৃতির কথাও উঠে আসে নাই। এই অভিযোগের মূল কারণটা হলো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপারগতা। শেখ মুজিব যুদ্ধ পূর্ববর্তী আন্দোলনে নেতৃত্বের স্থানে থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধ তার নেতৃত্বে কিংবা অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়নি। তিনি সেসময় পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। কেউ কেউ বলতে চান, ফলে তার এক ধরনের অ্যালার্জি ছিল মুজিবনগর সরকারের প্রতি। তাকে ছাড়া এত বড় একটা যজ্ঞ হলো অথচ তিনি পৌরোহিত্য করতে পারলেন না এটাই ছিল তার সেই অ্যালার্জির কারণ। অভিযোগের মূল সুরটা এরকমই।
আমি এ ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো নিজস্ব মন্তব্য যোগ করলাম না। এটুকু আমি বুঝি, ইতিহাস সত্যটা ঠিক বের করে আনে এবং মানুষ সত্যটা ঠিক বুঝতে পারে। যারা পারে না তারা নিজেরাই ইতিহাস হয়ে যায়। বলতে পারেন, ইতিহাসের খারাপ নজির হয়ে যায়। সদ্য পতিত ফ্যাসিস্ট রেজিমের কথাই বলতে পারেন। তবে তারা খারাপ নজির হয়েছে সত্য না বোঝার জন্য নয়, অস্বীকার করার জন্য। যা, না বোঝার চাইতেও খারাপ। না বুঝতে পারাটা ভুল, কিন্তু অস্বীকার করাটা অন্যায়, পাপও বলতে পারেন। তারা ইতিহাসের সত্য না বুঝতে পারলে হয়তো পতনটা এমন হতো না, আরো সফ্ট হতো। তারা ইতিহাসের সত্যটাকে অস্বীকার করেছে। তাই তাদের এমন পতন। কিন্তু যারা এই রেজিমের পতন ঘটালো তারা কি সেই মুজিবনগর সরকারের অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আসবে বা আসি আসি করছে, তারা কি ২৪ এর বিপ্লব পরিচালন কিংবা অংশগ্রহণের ব্যর্থতায় বিপ্লবীদের অস্বীকার করতে চাচ্ছে কিংবা উপেক্ষা? প্রশ্নটা রইলো তাদের কাছেই। ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না। শেখ মুজিবকেও করেনি, তার কন্যা হাসিনাকেও না। ভবিষ্যতেও কাউকে করবে না।
এখন আসি বিগত রেজিম ইতিহাসের কোন সত্যটা অস্বীকার করলো সে বিষয়ে। তারা সরাসরি জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করেছে। বাংলাদেশ নামক দেশটির অভ্যুদয়ে যে নামটি অবিচ্ছেদ্য, সে নামটিকে তারা বিনাদ্বিধায় অস্বীকার করেছে। এটা ভুল বা অন্যায় নয়, পাপ। জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টিকে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল বিগত রেজিম। তবে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলও সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার ব্যর্থতা অস্বীকার করতে পারে না। জিয়াউর রহমান যেটা শেখ মুজিবের নামে দিয়েছিলেন সেই ঘোষণাপত্রই শুধু আলোচ্য থেকেছে উভয়পক্ষেই।
কিন্তু জিয়াউর রহমান যে প্রথম ঘোষণাটি দিয়েছিলেন তা কিন্তু আলোচনায় আসেনি। সে ঘোষণাই প্রথম ঘোষণা এবং নিজেকে দেশের প্রধান হিসেবেই তিনি সে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মী সম্ভবত উনার নাম বেলাল, সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এর বৃত্তান্ত। ২৬ এবং ২৭ তারিখের বিতর্ক এ দুটি ঘোষণাকে ঘিরেই। অথচ যে প্রথম ঘোষণাটির কথা বলা হয় তা নিয়ে কোথাও আমি বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী কিংবা দলীয় কোনো নেতাকে জোরালোভাবে বলতে শুনিনি। কেন শুনিনি এ প্রশ্নটার উত্তর এখনো অজানা। তবে কি বিরোধীপক্ষ তো আছেই, নিজের দলেরও কেউ জিয়াউর রহমানের অবস্থানটা যাতে অন্য কারো অবস্থানকে স্পর্শ না করে সেই চেষ্টাটা করেছেন? এ প্রশ্নটাও রইলো।
‘এবি পার্টি’র ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেছেন, বিএনপি জিয়ার রাজনীতিটাই অনুধাবন করতে পারেনি। কথাটা সর্বাংশে মিথ্যা নয়। জিয়াউর রহমানের রাজনীতিটাই দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের পালস বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশের মানুষ অতীতেও ভারতীয় তথা আর্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে। আর দাঁড়ানোটা উচিত। কারণ আর্য আধিপত্যবাদীরা কখনো নিজের উপর তো দূরের কথা পাশাপাশিও কাউকে স্থান দিতে চায়নি। অর্থাৎ তারা কখনো বন্ধু চায়নি, দাস চেয়েছে। আর এই ভূখণ্ডের স্বাধীনচেতা মানুষ কখনো দাস হয়ে চায়নি। মানুষের এই পালসটাই বুঝতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি বুঝেছিলেন শুধুমাত্র একটা কারণেই শাহ আজিজুর রহমানের মতন মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিল। তাদের ভয় ছিল, পাকিস্তান থেকে আলাদা হলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের করালগ্রাসে বিলীন হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এখন প্রশ্ন করি, শাহ আজিজুর রহমানদের সেই ধারণা কি খুব একটা ভুল ছিল? বাংলাদেশের বুক চিরে রেলপথ, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট। বন্দর দখল, ব্যবসা দখল সবই তো করেছে ভারত। বাংলাদেশকে দীর্ঘ দেড় দশক রক্ষিতার মতন ব্যবহার করেছে তারা। বিগত রেজিম যাকে নরমভাবে আখ্যা দিয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বলে। তিতাসের উপর বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বন্ধ করে দিয়ে ভারতীয় গাড়ি চলাচল করেছে। চিন্তা করতে পারেন কতটা নত হলে একটি সরকার ভিন দেশের আবদারে নিজের নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে দিতে পারে! অসময়ে পানি ছেড়ে রাজনৈতিক বন্যা সৃষ্টির কথা আর নাই বললাম। নাই তুললাম ইন্দিরা গান্ধীর চালাকির কথা, পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা। বিকল্প থাকতেও ভারতের পণ্য কিনতে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের। এখন দেখুন তো, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, আলু ভারত থেকে আমদানি না করলে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। অমৌসুমে, ভরা বর্ষায় পেঁয়াজের কেজি চল্লিশ টাকা অতিক্রম করেনি। জানি, কেউ এর বিপরীতে অর্থনীতির নানান ডাটা দেবেন, আর কপচাবেন গেল গেল বলে। ওই যে, ট্রল করলো না, সব্জির দাম কম বলে। এরা এতই বোকা যে, নিজেরা অর্থনীতির ‘অ’টাও বোঝেন না কিন্তু কথা বলেন বিজ্ঞের মতন। অনেকটা তোতাপাখির পড়ানো কথা। ওই যে আবিদ আনোয়ার কবিতায় বলেছিলেন না, ‘বিয়েবোর সাধ্য নেই - রমিজের বন্ধ্যা কুকুরী তবু পোয়াতির মতো হাঁটে। এরা হলো সব রমিজের বন্ধ্যা ‘ইয়ে’ আর কী।
যাকগে এদের কথা না বলাই ভালো। কথা বলছিলাম জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। বাংলাদেশের এক অন্ধকার সময়ে তিনি এসেছিলেন আলোর মতন। রাত যত গভীর হয় ভোর তত নিকটে, তিনি ছিলেন সেই নিকটতম ভোর। তিনি বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবার পর মিরাকল ঘটে গিয়েছিল। সারাদেশটাই জেগে উঠেছিল। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ঘুরে দাঁড়িয়েছিল প্রতিটা সেক্টর। পারমাণবিক রিয়েক্টর বানিয়েছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী অভিযোগ করেছিলেন, এটা এটম বোমা বানানোর প্রস্তুতি। কারণ, ভারত বুঝতে পেরেছিল পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ তাদের কব্জা থেকে বের হয়ে গেছে। তাই একপ্রান্তে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান, আরেক প্রান্তে বাংলাদেশ যদি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে তো রীতিমতো ‘কেলো’। ভারতের বেজে বারোটা। এরশাদ এসে প্রথমেই সেই পারমাণবিক রিয়েক্টর নুলা বানিয়ে ছাড়লেন। এরশাদের সময়কালীন নিশ্চিন্ত ছিল ভারত।
এরশাদ পতনের পর যখন বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেন তখনই প্রমাদ গুনতে হলো ভারতকে। তাদের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু দেশের ভারতবিরোধী জনগণ সে ধারণা পূরণ হতে দেয়নি। যার ফলেই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তারা জানে ভারতবিরোধীরা ভোটে কখনও হারবে না। তারা ভারতবিরোধী শক্তিকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা থেকেও দেখেছে, কাজ হয়নি। বিএনপিকে ভেঙেছে। ইসলামিক শক্তিগুলো দল-উপদলে ভাগ করেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর ভর করতে হয়েছে। তাতেও শেষ রক্ষা হবে কিনা সেই সংশয়ে সুজাতা সিংকে পাঠাতে হয়েছে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে। এসব ইতিহাস তো সবারই জানা। দেড় দশকে দেশে কী ঘটেছে তা চোখের সামনে এখনো দৃশ্যমান।
২৪ এর ‘জুলাই বিপ্লব’ ভারতকে আবার সেই ৭৫ পরবর্তী সময়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা দেখেছে দেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে, এবার তাদের সামনে তরুণরা। যারা সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতন খুদ-কুড়োর বিনিময়ে আপস রাজি নয়। তারা মরতে জানে। তারা জিততে জানে। দেশের মানুষ এই তরুণদের পেছনে দাঁড়িয়েছে আপোসহীন প্রতিজ্ঞায়। ভারতের পালিত রেজিমের পতন ঘটেছে। যে পতন সারাবিশ্বে নজিরবিহীন। একটি ফুল ক্যাবিনেট পালিয়ে গেছে। সাথে গেছে নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর লোকজন। এমনকি তল্পিবাহক মসজিদের ইমামও পালিয়ে গেছে। ভারতের অবস্থা হয়েছে ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে’ গানটির মতন।
গান থাক, রূঢ় কথায় আসি। মোনাফেক চিহ্নিত হয়ে থাকে যুগে যুগে। মীর জাফর, নামটা এমনিতেই ঘৃণাযোগ্য হয়নি। অতএব মীর জাফর হবার সুযোগ নেই। আবার বলি, রক্তের সাথে বেইমানি ক্ষমার অযোগ্য। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ভবিষ্যতেও করবে না। মাইন্ড ইট।