বিএনপির তারুণ্য ভাবনা ও এর প্রতিফলন

প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১১:৫৭ পিএম

গত ৯ ই মে, শুক্রবার, ২০২৫ থেকে বিএনপি বাংলাদেশে এক নতুন ধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সূচনা করে। 'তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ' এই স্লোগানকে সামনে রেখে ও হৃদয়ে ধারণ করে বিএনপির তিনটি অঙ্গসংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের উদ্যোগে তরুণদেরকে নিয়ে দুইদিন ব্যাপী একটি সম্পূর্ণ নতুনধারার প্রাণবন্ত কর্মসূচির সূচনা করে। এই দুই দিনের প্রথম দিন ছিল বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা যেখানে অংশগ্রহণ করেছেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ, উদ্যোক্তা, বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সফল প্রবাসী, অন্য দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ইসলামি চিন্তাবিদ। আর দ্বিতীয় দিন ছিল তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ।
দুই বা ততোধিক বিভাগের তরুণদেরকে নিয়ে একটি জেলায় বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা ছিল
বৈচিত্র্যময়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিক নির্দেশনায় এই কর্মশালাগুলোতে বক্তৃতা করেছেন বিএনপি ঘরনার বাইরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যা সুধীমহলে ও সারা দেশব্যাপী প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। কারণ বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে এই ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এই প্রথম।
চারটি জেলার এই কর্মশালায় মোট ৩৭ জন প্যানেলিস্ট বক্তৃতা করেছেন। এখানে এমন মানুষও বক্তৃতা করেছেন যিনি সবসময়ই কট্টর বিএনপি সমালোচক ছিলেন। দেশনায়ক তারেক রহমান এমনটাই চেয়েছেন যেন তরুণ সমাজ দেশের সব মত ও পথের মানুষের কথা শুনতে পারে এবং নিজেদেরকে আলোকিত করতে পারে।
কর্মশালার বিষয় ও স্থান ছিল:
১. কর্মসংস্থান ও বহুমাত্রিক শিল্পায়ন নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা- চট্টগ্রাম।
২. শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকার নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা-খুলনা।
৩. কৃষি উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা ও নাগরিক সমস্যা নিয়ে তারুণ্যের ভাবনা-বগুড়া।
৪. তারুণ্যের রাজনৈতিক ভাবনা ও অর্থনৈতিক মুক্তি- ঢাকা।
৯ ই মে থেকে ২৮ ই মে পর্যন্ত বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে একটি বৈচিত্র্যময় ও দিকনির্দেশনাময় পথ দেখানোর জন্য, তরুণদেরকে নিজেদের সমস্যা ও দেশের সমস্যাগুলোকে লিপিবদ্ধ করে কীভাবে এগুলো সমাধান করা যায় এবং কি কি কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া যায়, এই ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করাটাই ছিল বিএনপির প্রয়াস। আশা করি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং বি এনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে যে উদ্যোগ নিয়েছে এবং যে প্রস্তাবনাগুলো এসেছে তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
কর্মশালাগুলোতে উঠে আসা প্রস্তাবনা:
বিএনপির তিন অঙ্গসংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল আয়োজিত কর্মশালাগুলোতে ৩৭ জন আলোচক বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবনার উল্লেখ করেছেন।
তরুণদের কর্মসংস্থান এবং শিল্পায়নের ব্যাপারে উঠে এসেছে :
১. চাকুরিবিহীন তরুণদের একটা ডাটাবেইস তৈরি করা
২. কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো।
৩. ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানো এবং পাবলিক এডুকেশনের মান বাড়ানো। ইংরেজি ও বাংলার পাশাপাশি তৃতীয় কোনো ভাষায় দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।
৪. ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে জেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়ানো।
৫. প্রবাসে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
৬. ডাটা কালেকশন, ডাটা অ্যানালাইসিস ও ডাটা ম্যানেজমেন্টে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা।
৭. Google, Yout tube, Meta এদের আঞ্চলিক অফিস বাংলাদেশে খোলার ব্যবস্থা করা কারণ কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবেও ভাল ক্যারিয়ার গড়া যায়।
৮. ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পে পল এর ব্যবস্থা করা।
৯. নির্বাচনী রোডম্যাপের কথা এসেছে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া সামগ্রিক ও সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। নির্বাচিত সরকার ছাড়া FDI এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকেনা। তারা insecured( ব্যাবসায়িক নিরাপত্তাহীনতায়) ভোগে। ফলে স্বভাবতই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান লোপ পায়।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকার নিয়ে তরুণদের ভাবনায় উঠে এসেছে:
১. তরুণদেরকে মাদকমুক্ত রাখার জন্য প্রাইমারি লেভেল থেকেই এর কুফল সম্বন্ধে পাঠদান করা এবং মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বাড়ানো।
২. "মেইড ইন বাংলাদেশ" মেডিকেল প্রডাক্টের ব্যাপারে উৎসাহিত করা। NHS এর আদলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রণয়ন করা এবং নার্স ও ডাক্তারদের রোগীদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য মোটিভেট করা।
৩. থাইল্যান্ডের আদলে মেডিক্যাল শিক্ষা প্রণয়ন করা যেখানে ছাত্র বা ছাত্রী যে ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলা থেকে এইচএসসি পাশ করবে সেই জেলাতেই তাদেরকে মেডিকেল পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া। এবং পাশ করার পর একটা নির্দিষ্ট সময় তাদেরকে ঐ জেলায়ই কাজের সুযোগ করে দেয়া।
২. প্রাথমিক শিক্ষা পুনঃনিরীক্ষণ করা এবং প্রাইমারি শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে কোয়ালিটি শিক্ষক নিয়োগ করা।
৪. উচ্চ শিক্ষাকে উন্নত বিশ্বের উপযোগী করা এবং গ্লোবাল ম্যানপাওয়ার বাড়ানোর ব্যবস্থা করা।
৫. সহজলভ্য শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা করা এবং ৪ থেকে ৬ বছর মেয়াদি শিক্ষাঋণের ব্যবস্থা করা।
৬.ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করা এবং এর মূল্য বর্তমানের এক তৃতীয়াংশ করা।
৭. ভোকেশনাল ট্রেইনিং এর পরিধি বাড়ানো এবং একে যুগোপযোগী করা।
৮. তরুণদের মৌলিক অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়া এবং গ্লোবাল প্লাটফর্মে কাজ করার প্রয়াস বাড়ানো।
কৃষি উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা ও নাগরিক সমস্যা নিয়ে তারুণ্যের ভাবনায় এসেছে:
১. খাল খনন কর্মসূচি যেভাবে বিপ্লব ঘটিয়েছিল কৃষিতে,তার পুনঃপ্রবর্তন করা।
২. প্রথাগত ইটভাটা বন্ধ করে আধুনিক প্রযুক্তির ইট তৈরির কারখানার দিকে মনোনিবেশ করা।
৩. কৃষকদেরকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা, সার যেন সঠিক সময় পায় এবং স্বল্পমূল্যে পায় সেই ব্যবস্থা করা।
৪. ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো এবং বনায়ন বৃদ্ধির চেষ্টা করা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে।
৫. বগুড়া শহর সিটি কর্পোরেশন এ উন্নীত হলে সব ক্ষেত্রে যেন সুষম উন্নয়নের ছাপ থাকে, কৃষি জমি ভরাট করে যেন কোন উন্নয়ন না করা হয়, গ্রামের মানুষ যেন গ্রামে থাকে সেই ব্যবস্থা করা অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণ এর উপর জোড় দেওয়া, রাস্তার আকার বাড়ানো, শুধু বহুতল ভবন নয়, দক্ষ নগর পরিকল্পনাবিদের মাধ্যমে একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা যাতে করে অপরিকল্পিত নগরায়ণ না হয়।
চতুর্থ আয়োজনটি ছিল ঢাকায় এবং চারটি বিভাগকে কেন্দ্র করে: ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর। আলোচ্য বিষয় ছিল, "তারুণ্যের রাজনৈতিক ভাবনা ও অর্থনৈতিক মুক্তি"।
একইসাথে গুরুগম্ভীর এবং হাস্যরসাত্মক আলোচনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি চলেছে।
এখানে তরুণদেরকে ভোটের অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে, ভোট কেন প্রয়োজন? ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা, বিএনপি প্রণীত ৩১ দফা, না ভোটের বিধান থাকা উচিত কি উচিত না, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবীর অর্ধেক কলাপ্স করবে( প্রতিষ্ঠানের নাম TSMC), ইন্টারনেটে ছড়ানো মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন, ফ্যাক্ট চেকিং এর প্রয়োজনীয়তা, জুলাই বিপ্লবে বিএনপির সক্রিয় ভূমিকা, সাইবার সিকিওরটি অ্যাক্ট এর মত কালাকানুনের প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মীদের জীবনের নাভিশ্বাস তোলে ফেলা সময়গুলোর কথা, ইসলামি মূল্যবোধ বজায় রাখা, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে ইসলামি মূল্যবোধ ধারণ করতেন সেখান থেকে বিচ্যুত না হওয়া এ ধরনের বিষয়গুলো বিস্তারিত খুব প্রাঞ্জল ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। একজন বক্তা খুব আবেগপ্রবণভাবেই বলেছেন, তিনি ছাত্রদল না করা সত্ত্বেও, একটি বিপরীত ছাত্র সংগঠনের হওয়ার পরও কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ১৯৯৩ সালে একটি চিঠি লিখে ওয়ার্ল্ড ডিবেট এ অংশগ্রহণ করার জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ফান্ড পেয়েছিলেন। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন বেগম খালেদা জিয়ার কথা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর কথা।
বিএনপির এই "তারুণ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ" শিরোনামে প্রত্যেকটি কর্মসূচিরই কর্মশালার দ্বিতীয় দিন ছিল তারুণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ। যথারীতি চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়াতে সমাবেশের পর সর্বশেষ সমাবেশটি হয় ঢাকায় গত ২৮ শে মে নয়াপল্টনে। দেশনায়ক তারেক রহমান এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তরুণদেরকে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তার বক্তব্যে ছিল না কারও সম্বন্ধে কোন কুৎসা, কাউকে হেয় করা, না পাওয়ার বেদনা এই সংক্রান্ত কোন কিছু। উনি
যথাযথই দেশের সামগ্রিক ভাল র জন্য, সুষম উন্নয়নের জন্য, মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা বলেছেন। দেশে যেন আর বিশৃঙ্খলা না হয়, দেশ যেন সঠিক পথে থাকে, দেশের মানুষ যেন তাদের দীর্ঘদিনের হারানো গণতন্ত্র ফিরে পায়, সেজন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। তরুণদের উদ্দেশ্যে দেশনায়কের সেই কাব্যিক ও অনুপ্রেরণা দায়ক উক্তি যা কোটি কোটি তরুণের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে:
"দিল্লী নয়, পিণ্ডি নয়,
নয় অন্য কোন দেশ;
সবার আগে বাংলাদেশ।"
'সবার আগে বাংলাদেশ' এই মর্মবাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি যে নতুন দিগন্তের, নতুন রাজনীতির, তরুণদের আস্থার রাজনীতির, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির সূচনা করল তা যুগ যুগ ধরে এই দলকে মানুষের মনিকোঠায় স্থান করে দিবে।
প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান,
[email protected], Facebook: Salahuddin Ahmed Raihan