
ছবি: সংগৃহীত
গণতন্ত্র শব্দটি এখন কারো কথায় মনে হচ্ছে খুবই সহজসাধ্য একটা বিষয়। ভোট হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। ভোট গণতন্ত্রের জন্য যেমন অত্যাবশ্যকীয়, তেমনি ভোট গণতন্ত্র ধ্বংসেরও হাতিয়ার। গত দেড় দশকে সেই ধ্বংস আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে, ভোটের সাথে আরও কিছু উপকরণ জরুরি।
প্রশ্ন রাখি, ভোট কারা করেন? ভোট দেন জনগণ, কিন্তু সেই ভোট করানোর পেছনে থাকে হলো প্রশাসন আর বিভিন্ন বাহিনী। ২০১৮ আর ২০২৪ এর নির্বাচন দেখেন, দেখবেন সেই ভোটে প্রশাসন ছিলো, পুলিশ ছিলো, বিজিবি ছিলো, সেনাবাহিনী ছিলো। কিন্তু ভোটের ফলাফল সেই অশ্বডিম্ব। সেই অশ্বডিম্ব প্রসবের কারিগরদের কি সরানো গেছে, তারা কি সংশোধিত হয়েছেন? উত্তর একটাই, না। তাহলে আপনি ভোট করবেন কী করে!
বিগত রেজিম প্রতিটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছে। ধ্বংসের ব্যাপারটি যেমন সত্যি তেমনি সত্যি তেপান্ন বছরেও বাংলাদেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দাঁড় করানো যায়নি। এই দেশে তিনটি দল রাজত্ব করেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এ সময় জামায়াতসহ অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি দলও ক্ষমতার ভাগীদার ছিল। এরা কেউই একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দাঁড় করাতে পারেনি। পারেনি লোকবল দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে। ফলে কী হয়েছে, ভোট করতে গেলে নির্বাচন কমিশনকে নির্ভর করতে হচ্ছে প্রশাসন ও বাহিনীর উপর। এই যে, প্রশাসন ও বাহিনী নির্ভরতা তা নির্বাচন কমিশনকে মূলত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। নির্বাচন কমিশন যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো, ভোটের সময় যদি জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অধীন থাকতেন। উপজেলাগুলিতেও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অধীনে থাকতেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর থানার ওসিগণ। বিশেষ করে তাদের তাৎক্ষণিক বদলি এবং চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতা যদি থাকতো নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর, তাহলে প্রশাসন ও বাহিনী অনেকটাই আয়ত্তে থাকতো, নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করতো। কিন্তু বাস্তবে কী দেখি, দেখি, কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। নির্বাচন কমিশনকে লোকবল দিয়ে কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চায়নি। সুতরাং ভোটের অনিয়মের দায়িত্ব কেউই এড়াতে পারবে না, না কোনো দল, না ব্যক্তি। আরেকটা মজার কথা হলো, ‘ব্যালট নয় বুলেট’ এর মাধ্যমে যারা ক্ষমতা পরিবর্তনের কথা বলতেন, সেই নকশালপন্থীদের কেউ কেউ আজকাল ভোটের ছবক, গণতন্ত্রের তবক দিয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন তো, ভোট আর গণতন্ত্রের অবস্থাটা।
যে ভারত আমাদের দ্রুত এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিচ্ছে, সেই ভারতের দিকেই তাকান। সেখানের নির্বাচন কমিশন এতটা শক্তি ধরে যে, তারা মোদি এবং রাহুলের বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠাতে দ্বিধা করে না। প্রয়োজনে গ্রেপ্তারেও দ্বিধা করে না ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। ভারতের মতন একটি জোড়াতালি দেওয়া দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশন সত্যিকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠায়। জোড়াতালি বললাম এই কারণে যে, ভারত বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের দেশ, বিভিন্ন চিন্তার মানুষের দেশ। ভারতের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয়। সেসব অঙ্গরাজ্যের বিশাল সংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা চায়। কিন্তু শক্তি দিয়ে সেই চাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এমন একটা দেশে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না হলে গণতন্ত্র টেকসই হওয়া অসম্ভব।
এই টেকসই গণতন্ত্রই আমাদের দেশে প্রয়োজন। আবার বলছি গণতন্ত্র নয়, টেকসই গণতন্ত্র। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর সবার আশা জেগেছিল এবার বুঝি আমরা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাবো। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। চব্বিশে আবার আশা জেগেছিল, কিন্তু সে আশাতেও গুড়েবালি’র আমদানি দেখতে পাচ্ছি। গুড়েবালি’র নমুনা দেখাই। ভারতের কথা বলছিলাম, ভারত তার নিজের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন করেছে। কারণ তাদের নেতারা বুঝেছে, এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীন না হলে দেশই টিকবে না। আর দেশ না টিকলে আমাদের শাসন করার ক্ষমতাও থাকবে না। তারা নিজের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন করেছে। অথচ পাশের দেশগুলিতে ভারতের কারবার উল্টো। ভারত সেখানের নির্বাচনে নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বিগত নির্বাচনে যখন বিএনপি অংশ নেয়নি, তখন ভারত অন্যকটি দল দেখিয়ে বলেছে, কয়েকটি দল যায়নি কিন্তু অনেকদল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, ফলে নির্বাচন অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়েছে। অথচ এবারের নির্বাচনে ভারতের উল্টো সুর। তারা এক আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ না থাকার সম্ভাবনাকেই অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচনের অন্তরায় হিসেবে দেখছে। আগে নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলতো, এখন উল্টো, যেন বাংলাদেশের নির্বাচনের আন্তর্জাতিকীকরণ হয়ে গেছে! সেজন্যই গুরুজনরা বলে গেছেন, ভারত যা বলে তার উল্টো দিকে থাকাটাই দেশপ্রেম।
যাকগে, টেকসই গণতন্ত্রের কথায় আসি। তার আগে বলি আমাদের চাওয়াটা আসলে কী, আমরা কি দুদিন পরপর ভেঙে পড়ে এমন গণতন্ত্র চাই। একাত্তর, নব্বইয়ের মতন কি চব্বিশেও আমরা সেই পুতুল খেলাই খেলবো, নাকি গণতন্ত্রের একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেখতে চাইবো। নাকি ভোট-ভাট এর দাবি করা ইউটিউবার বুদ্ধিজীবী হবো! কথায় কথায় যেনতেন ভোট মানেই গণতন্ত্র এমন উদ্ভট যুক্তি দেব! মোদ্দকথায় এখন সব ভেবে দেখার সময় এসেছে। চব্বিশ আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এই সুযোগ হারালে একাত্তরের পর যেমন আমরা প্রতারিত হয়েছিলাম, নব্বইয়ের পরও একই অবস্থা, আবার আমরা সেই প্রতারণার কবলেই পড়বো। ক্ষমতায় যে যাবে সেই লুটেরা হয়ে উঠবে। সেই লুটেরাদের হঠাতে আবার আমাদের জীবন দিতে হবে। বাড়তে থাকবে ক্রমান্বয়ে শহীদী কাফেলা।