
ভাবছি। ড. ইউনূস চলে গেলে তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন। যদিও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘জনগণ বিকল্প খুঁজে নেবে’। জনগণের এই আলাপ ইতোপূর্বে বহুবার শোনা। জনগণ চায়, চায় না- এসব শুনে কান পচে গেছে। তাই এসব মেঠো কথায় কথা বাড়াচ্ছি না। মূলকথায় আসি, গত দেড় দশক সাথে সেনা শাসনের অর্থাৎ মঈন-ফখর এর দুই বছর ধরলে সতেরো বছর ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে দেশ চলেছে। আশা করি বোকার মতন কেউ প্রশ্ন করবেন না, কীভাবে চললো- এমন কথা বলে।
ভারত বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছে এতদিন অনেকটা রক্ষিতার মতন। সরি টু সে। কিন্তু কথা সত্য। ভারত বাংলাদেশের প্রাপ্য দেয়নি, কিন্তু নিজেরটা বুঝে নিয়েছে পুরোপুরি। সেই ভারত জুলাই বিপ্লবের পর বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। সেই বিঘ্নিত হবার কারণ হলো জুলাই পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের প্রাপ্যটা বুঝে নিতে শিখেছে।
এতদিনের চাল-ডাল-পেঁয়াজ বন্ধের হুমকিকে সফলভাবে মোকাবেলা করেছে। করিডোর, ট্রানজিট সব বন্ধ। বন্দর হাতছাড়া। কিন্তু এর বিপরীতে ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই করতে পারছে না। আগে যেমন সাম্প্রদায়িকতার অজুহাত তুলে, জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে সারাবিশ্বে কালিমালিপ্ত করা হতো, সেই চেষ্টাও মার খেয়েছে। কোনো দিক দিয়েই আন্তর্জাতিক সমর্থন জুটছে না ভারতের কপালে। যার ফলে ড. ইউনূস ভারতের জন্য এক বিশাল ‘প্যারা’র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গতই ভারত আপ্রাণ চাইবে ড. ইউনূসকে হঠাতে। এখানে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ নামক রামছাগলটার কথা আর নাই তুললাম। সত্যি কথা বলতে দক্ষিণ এশিয়ায় ড. ইউনূস ভারতের সবচেয়ে সবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন। তাই তাকে বসিয়ে দেয়ার কোনো বিকল্প ভারতের কাছে নেই। পদত্যাগের আলাপ উঠতে ভারতের মিডিয়া সে কথারই প্রমাণ দিয়ে চলেছে। ভারতের কাছে সবচেয়ে প্রার্থিত হয়ে উঠেছে যে কোনো উপায়ে ড. ইউনূসকে অপসারণ। আমরা সেই চেষ্টাই দেখছি।
এর বাইরেও ভাবনা রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা কিছুটা অদ্ভুত। গত সতেরো বছর ধরে গণতন্ত্রের ধারেকাছে নেই আমরা। সতেরো বছর অপেক্ষা করলাম, কিন্তু এখন সতেরো মাস আমাদের সইছে না। আমাদের অতি বুদ্ধিজীবী কিছু মানুষ, কথায় কথায় নানান বিচ্যুতির কথা তুলছেন। মজার কথা হলো তারমধ্যে বামেরাও রয়েছেন। বাম বুদ্ধিজীবীগণ আর কী। তারা তো পড়াশোনা জানা মানুষ। তাদের ভাষায় বিএনপি নয় বুর্জোয়া দল। দলটির নেতাকর্মীরা মার্ক্সবাদ জানে না, পড়াশোনা নেই, তারা না হয় অবুঝের মতন কথা বলে। কিন্তু তারা কি ফরাসি বিপ্লব বিষয়ে পড়েনি। তারা কি জানে না বিপ্লবের পর কী কী ঘটেছিল। কত বছর লেগেছিল দেশটি স্থিতিশীল হতে। তারপর বিপ্লব বিরোধীদের কী পরিণতি হয়েছিল। তাদের তো বলশেভিক বিপ্লব মুখস্থ থাকার কথা একেবারে তোতাপাখি স্টাইলে। তারা কি জানে না বলশেভিক বিপ্লবের পর কী অবস্থা হয়েছিল। বিরোধীদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছিল। সেই বামেরা আট মাসেই সব গুলে খেয়ে সব চেয়ে বসছেন। আজব না।
এই আজব ব্যাপারগুলোই ভাবছি। ভাবছি, সচিবা যদি এখন রাজনৈতিক ভাষ্য দিতে শুরু করেন কিংবা পুলিশের লোকজন, তাহলে কেমন হবে? তাদের বাধা দেবার নৈতিক অধিকার কী যারা নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করছেন, তাদের রয়েছে? কি বলেন, রয়েছে? এই না থাকাটা নিয়েই ভাবছি। কেউ কেউ বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নাকি আইনগত বৈধতা নেই। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন নেই, সেই জবাব তারা দিতে পারবেন না। কারণ তাদের দেয়ার নৈতিক অধিকার নেই। যেমন নেই অবৈধ নির্বাচনকে বৈধ করে তোলার অযাচিত প্রয়াসের। অবৈধ নির্বাচনের বিরোধিতা করায় যারা জীবন দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের কাছে সেই প্রয়াসের জবাব কী? কোনো জবাব নেই। সেই না থাকাটা নিয়েও ভাবছি।
সাথে ভাবছি, পছন্দের লোক বিষয়ে। ইন্টেরিম এর উপদেষ্টাদের নিয়ে দুটি পক্ষ ভাগ হয়ে গিয়েছেন। একপক্ষ আরেকপক্ষের পদত্যাগ চাইছেন। বিষয়টি বেশ কৌতুকপ্রদ। তারা দুই পক্ষই বলছেন, তাদের অপছন্দের উপদেষ্টারা ব্যর্থ। দুইপক্ষের হিসেব যখন টানতে যাই, তখন সব উপদেষ্টারাই ব্যর্থ। তাই যদি হয়, তবে গত আট মাসে যে-সকল ভালো কাজ হলো, তা করলো কারা! নাকি সেই কৌতুকের মতন, ‘খারাপ করলে আমি, আর ভালো করলে ভগবান’। ভালো কাজগুলো তাহলে কোন ভগবান করে গেলেন? ভাবছি, এই প্রশ্নের উত্তর কি মোদিজি? না, দক্ষিণ এশিয়াতে তো স্বঘোষিত অজৈবিক মানুষ একজনই আছেন, তাই ভাবা আর কী। এই ভাবনা যদি সঠিক হয়, তাহলে তো ড. ইউনূসকে হঠাতেই হয়, কি বলেন?
চলেন তাহলে, ব্যাঙের সর্দি হবার অজুহাতে ড. ইউনূসকে হঠাতে নেমে যাই। জনগণ বিকল্প বার করুক, না হলে তো বিকল্প দাবি করা লোকজন রয়েছেই। প্রেসক্লাবের সামনে দেখলাম একজন নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের দাবিতে ব্যানার টানিয়ে বক্তব্য রাখছেন। সেও বিকল্প হতে পারেন। অসুবিধা কী তেমনি একজন দীর্ঘদিন দেশ চালাতে পারলে, সে পারবে না কেন? সেই কেন এর উত্তরও ভাবছি।
সত্যি বলতে ভাবা ছাড়া আমাদের ফেসবুক সেলিব্রেটি ভাবুক, টকশো ভিত্তিক বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীরই তো কোনো কাজ নেই। তারা জুলাই বিপ্লবে ঘরে বসে সম্ভবত ফ্যাশন টিভি দেখেছেন, নয়তো ক্রিকেট। আর উড়িয়ে দিয়েছেন যে, বাচ্চা-বাচ্চা পোলাপানরা আর কী করবে, সতেরো বছর ধরে বুড়োরাই যা করতে পারেনি। তারপর ৩৬ জুলাই সংঘটিত হলো, উনারা আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে বলতে শুরু করলেন, বলেছিলাম না, এমনটা হবে। এখনো বলে চলেছেন। আমি ভেবে চলেছি, আপনারা মূলত কী বলেছিলেন সেই কথা। কিন্তু ভেবে কিছু মনে করতে পারছি না। মনে করতে পারছি না, আপনাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল কিনা বিগত রেজিম হঠাতে। ছিল কি?
ফুটনোট: কেউ বলছেন, ড. ইউনূস পদত্যাগ করে দল গঠন করুন। এক্ষেত্রে মাহাথিরের উদাহরণ টেনেছেন। ভাবছি, মাহাথির ও ইউনূসের মিল-অমিল নিয়ে। মাহাথিরের উত্থান রাজনৈতিক। যাদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে তাদের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। জিও-পলিটিক্স তাই বলে। কিন্তু ড. ড. ইউনূসের উত্থান রাজনৈতিক নয়। তার থিওরি বিশ্বের একশ উনিশটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ায়। খোদ ভারতেও তার থিওরি পড়ানো হয়। চীন ও আমেরিকাতেও। অর্থাৎ শত্রু-মিত্র সবদেশে। বিশ্বের সবকয়টি সম্মান তার ঝোলায়। সুতরাং তাকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলা খুব কঠিন। ভাবছি, আমাদের ফেসবুক সেলিব্রেটি অতি-শিক্ষিত মানুষেরা কীভাবে ড. ইউনূসকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলার থ্রি জেরোর বিকল্প থিওরি দিবেন।