
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আজ বারবার উঠে আসছে—আগামী নির্বাচনে কাকে ভোট দেওয়া হবে এবং কাকে নয়। এই সিদ্ধান্ত কেবল দলীয় আনুগত্য বা ধর্মীয় আবেগ দ্বারা নয়, ইতিহাসবোধ, মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে নেওয়া উচিত। এই প্রেক্ষাপটে আমার অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট: আমি জামায়াতে ইসলামীকে কখনোই ভোট দেব না। কেন দেব না—তা ব্যাখ্যা করতে চাই।
১.
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তা আজও জাতির স্মৃতিতে দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে। এই অপরাধের বিচার হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, এবং প্রমাণিত হয়েছে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ। এই দলটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, বাংলাদেশের জন্মকে ঠেকাতে চেয়েছিল। তাদের কর্মকাণ্ড শুধু রাজনৈতিক ভুল ছিল না—তা ছিল জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা।
২.
অপরাধের পর অনুশোচনা প্রত্যাশিত হলেও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য জনগণের কাছে কোনো নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া হয়নি। তারা যুদ্ধাপরাধকে কখনোই স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনি, বরং বরাবরই একে ঢাকার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের একগুঁয়ে মনোভাব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নয়, বরং গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞার প্রতীক।
৩.
জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাসিক প্রকাশনা ছাত্র সংবাদ-এর একটি ডিসেম্বর সংখ্যায় “যুগে যুগে স্বৈরাচার ও তাদের করুণ পরিণতি” শীর্ষক প্রবন্ধে লেখা হয়, “অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।” ৫০ বছর পরও নিজেদের দলীয় প্রকাশনায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণকে ‘ভুল’ এবং ‘পাপকাজ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই বক্তব্য শুধুমাত্র চরম ঔদ্ধত্যের বহিঃপ্রকাশ নয়; এটি একাত্তরের পরাজিত শক্তির চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা।
এই ভণ্ডামি তখনই প্রকট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, একদিকে তারা স্বাধীনতা দিবসে ‘স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখব’ বলে স্লোগান দেয়, অন্যদিকে নিজেদের প্রকাশনায় মুক্তিযুদ্ধকে দোষারোপ করে। এ দ্বিচারিতা প্রমাণ করে, প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কেবল রাজনৈতিক মুখোশ মাত্র।
৪.
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জামায়াতের আমির আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ করে যে ‘ক্ষমা’ ঘোষণা দেন, তাতে শহীদদের রক্তের প্রতি চরম অবমাননা প্রকাশ পায়। জামায়াত তখন বলেছিল—“এরা তো আমাদের আত্মীয়, এদেরকে জালিম বলা যায় না।” অথচ এই আওয়ামী লীগই ছিল তাদের দৃষ্টিতে ‘সেক্যুলার’ ও ‘ইসলামবিরোধী’ দল। রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় এইরূপ ভণ্ডামি প্রমাণ করে, আদর্শ নয়, জামায়াতের রাজনীতি চরম সুবিধাবাদিতায় বিশ্বাসী।
৫.
গত ১৭ বছর ধরে ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকর্মী ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় থেকে সুবিধা নিয়েছে, এমন বহু প্রমাণ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ স্বয়ং ছাত্রলীগে পদের কথা স্বীকার করছেন । এমনকি ঢাবি শাখা শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কাইয়ূম শেখ মুজিবের ছবি শেয়ার, ছাত্রলীগের মিছিলে অংশ নেওয়া ইত্যাদি প্রকাশ্যে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে—যদি জুলাই আন্দোলন না হতো, তারা কি কখনও নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করত? তারা আদর্শের কথা বলে, অথচ গোপনে হালুয়া-রুটির ভাগ নেয়। এটি ইসলাম নয়, এটি রাজনৈতিক ভণ্ডামি।
৬.
বিএনপি ইতোমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা রূপরেখা প্রকাশ করেছে। কিন্তু জামায়াত জুলাই আন্দোলনের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো সুসংহত রাজনৈতিক রূপরেখা উপস্থাপন করতে পারেনি। প্রশ্ন জাগে—তারা আদৌ আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত কি না। নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের দাবি রয়েছে—তাদের ৪০% কর্মী নারী। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব কোথায়, কমিটি কোথায়, সাংগঠনিক কাঠামো কোথায়—সবই রহস্যাবৃত।
৭.
গোলাম আযমের মতো নেতার নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার বাহিনী সম্পর্কে ইতিহাসে অনেক প্রমাণ রয়েছে। দৈনিক সংগ্রামের ১৯৭১ সালের সংখ্যাগুলিতে রাজাকার বাহিনীর কার্যক্রমের বিবরণ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। গোলাম আযম স্বাধীনতার পরবর্তী সময় সৌদি বাদশাহকে চিঠি লিখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সে ইতিহাস আজও বিদ্যমান। অথচ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে স্লোগান হয়, গোলাম আযমের বাংলায়…………এটা জাতি হিসেবে কতটা লজ্জার ও অপমানের তা বলে শেষ করা যাবেনা। ৭১ এর শহীদরা বেঁচে থাকলে হয়ত আহাজারি করত যে এই জন্য আমরা দেশকে স্বাধীন করিনি।
তবে শুধু অতীত নয়, জামায়াত আজও এক আদর্শগত দ্বিধার মাঝে রয়েছে। তারা মুখে ইসলামের কথা বললেও বাস্তবে একটি বিভ্রান্তিকর মওদূদীধর্মী তত্ত্বে বিশ্বাস করে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ ইসলামি দল একমত নয়।
উপসংহার
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, আজও তারা সেই চেতনাগত অবস্থান থেকে সরে আসেনি। তারা তরুণ প্রজন্মের সামনে কোনো রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ, বরং ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ায়। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে নেই কোনো দায়বদ্ধতা বা স্বচ্ছতা।
একটি আদর্শিক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করা সময়ের দাবি। শহীদদের রক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ এবং জনগণের মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি দৃঢ়ভাবে বলি—আমি জামায়াতকে ভোট দেব না।-
লেখক: জোবায়ের হোসেন, কান্ট্রি-কো অর্ডিনেটর (মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুর), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে