প্রশ্ন ও মতামতের পার্থক্য বোঝার অক্ষমতা এবং আমাদের সাংবাদিকতা
আমি কলাম লিখি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, যখন আমি রিপোর্টিং করি, তখন আমি আমার নিজস্ব মত প্রকাশ করতে পারি না। না পারার সেই তাগিদে আমি আমার মতামত জানিয়ে যাই কলামে। খুব সিম্পল কথা। কিন্তু এই সরল কথাই বুঝতে পারেন না, অথবা বুঝতে চেষ্টা করেন না সো-কল্ড অনেক খ্যাত রিপোর্টার। সরি টু সে, তারা রিপোর্টার ও জার্নালিস্টের পার্থক্যও বোঝেন না।
না বুঝুক আপত্তি নেই। আপত্তিটা তখনই যখন একজন সাংবাদিকতার শিক্ষক এমন কারো পক্ষে সাফাই গান। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য হই এসব মানুষদের কতই না মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলাম আমরা। সাথে সময়কে ধন্যবাদ দিই তাদের আসল রূপটা উন্মোচিত করার জন্য। কনফারেন্স আর ব্রিফিংয়ের পার্থক্যটাও কথিত সাংবাদিক নামের রিপোর্টারগণ গুলিয়ে ফেলেছেন। যেমন গুলিয়ে ফেলেছেন প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের বিষয়টি সাথে প্রশ্ন ও মতামতের পার্থক্য। গুলিয়ে বা ঘুটিয়ে ফেলাকেই স্যালাইন হিসেবে পরিবেশন করতে চেয়েছেন কেউ কেউ, তাদের মধ্যে সাংবাদিকতার সেই শিক্ষকও রয়েছেন।
হ্যাঁ, বলছিলাম সংস্কৃতি উপদেষ্টার সাথে কতিপয় রিপোর্টার পদবির কথিত সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের পর্ব নিয়ে। ইতোমধ্যেই এটা বেশ আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ ঘটনায় দুটি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে তিন রিপোর্টারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই চাকরিচ্যুতি বড় তাৎক্ষণিক হয়ে গেছে বলে এর ন্যায্যতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। অবশ্য যারা তুলেছেন তাদের প্রশ্ন তোলার ন্যায্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যাক সে কথা, এখন আর তুলতে চাইছি না, সেটারও সময় রয়েছে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। অসময়ে যে কাজটা করতে গিয়েছিলেন তথাকথিত তিন সাংবাদিক।
চাকরিচ্যুতিটা কেন তাৎক্ষণিক এবং কিছুটা অন্যায্য হয়েছে তা বলছি। ক্রসফায়ার ও বিচারের মধ্যে পার্থক্য হলো, ক্রসফায়ার কোনো ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে না এবং তা তাৎক্ষণিক বলেই মানুষ ভুলে যায় দ্রুত। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে, সময় লাগে। তাতে মানুষের সামনে সত্যটা প্রকাশ্য হয়। ফলে তা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। মানুষ মনে রাখে। ক্রসফায়ার হলো তাৎক্ষণিকতা। হঠাৎ চাকরিচ্যুতিটা তাই। তাদের যদি শোকজ করা হতো, তাদের জবাবটা প্রকাশ্য করা হতো। ফলে তাদের অতীত কার্যক্রমের সাথে বর্তমান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করা সম্ভব হতো। প্রশ্ন করা যেত তাদের অসংগতি নিয়ে। জানি, তারা কোনো জবাব দিতে পারতেন না এবং তাদের চাকরিচ্যুতিটা তখন পরিপূর্ণ জায়েয হতো। চাকরিচ্যুতি তাদের স্বাভাবিক পরিণতি ছিল কিন্তু তাৎক্ষণিকতা তাদের সেই পরিণতিকে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এই সাংবাদিক কারা। তারা তো সেই জন, যারা মানুষ হত্যাকে জায়েয করার জন্য ক্রমাগত ন্যারেটিভ তৈরি করে গেছেন। যখন পুলিশের গুলিতে তরুণরা দলে দলে মারা যাচ্ছিলেন, তখনও তারা শাসকগোষ্ঠীকে আরো কঠোর হওয়ার তাগিদ দিচ্ছিলেন। যার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এই বর্ধিত হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দায় এড়ানোর কোনো জায়গা নেই। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ ভাবে পাচার হয়ে গিয়েছে দেশের বাইরে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে।
এসব জেনেও এই কথিত সাংবাদিকরা চুপ ছিলেন। শুধু চুপই ছিলেন না উল্টো পাচারের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছেন। মেকি উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিলেন বাস্তবতা। কে কারণে আমাদের টাকা যে লোপাট হয়ে যাচ্ছে তা আমরা জানতে পারিনি। যখন পেরেছি তখন আর করার কিছু ছিল না, ওই চেয়ে চেয়ে দেখার মতন। এর জন্য শাসকগোষ্ঠীর দোষের ভাগ গণমাধ্যমের এসব কর্মীদেরও রয়েছে। কিন্তু এরা শাস্তির আওতায় আসেনি। উল্টো তাদের বিতর্ক তৈরির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ হলো ক্ষমতাকেন্দ্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। বলতে চাইবেন, তারা তো তাই করেছে। কী করেছে, জাতিসংঘের তথ্যকে ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছে! জাতিসংঘের রেফারেন্সে সংস্কৃতি উপদেষ্টা কথা বলতে চাইলেন, তারা সেই কথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। অথচ তাদের উচিত ছিল জাতিসংঘ যখন রিপোর্ট প্রকাশ করলো, তখন সেই রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলা। বলতে পারেন, সেই সুযোগ তারা পাননি। তাহলে রিপোর্টিং ছেড়ে দিয়ে মতামত লিখুন, সেখানে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিন। বলুন, আমাদের প্রশ্ন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট ভুল ছিল।
তার আগে, তাদের নিজেদের কাছে পরিষ্কার হতে হবে, তারা ক্ষমতাকেন্দ্রকে ইতোপূর্বে কেন জবাবদিহিতার আওতায় আনেননি। তারা তো সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সুযোগ কেন কাজে লাগাননি। কেন মানুষ হত্যার বিপক্ষে দাঁড়াননি। কেন লুটপাটের বিরুদ্ধে প্র্রশ্ন তৈরি করেননি। প্রশ্ন আছে অনেক, উত্তরও তো জানা। কেন জানা, কারণ আমরা জানি তারা কারা। তাদের পরিচয় কী, কেন তারা প্রশ্নের নামে সংঘবদ্ধ মব তৈরির প্রচেষ্টায় ছিলেন। জানি, এসব ছিল, ‘আগেই ভালো ছিলাম’ বিষয়ক সম্মিলিত ক্যাম্পেইনের অংশ। ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের চেষ্টা।
ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে এসব দোসরদের ভূমিকা প্রত্যক্ষ। সরকার প্রধানের প্রেস কনফারেন্সে যখন সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে গান গাওয়া হয়, কবিতা আবৃত্তি করা হয়, তখন ফ্যাসিবাদ উজ্জীবিত হয়। অনেকটা মাঠের প্রান্ত ঘেঁষে থাকা চিয়ার্স-গার্লদের মতন। তারা সাংবাদিক না চিয়ার্স-গার্ল সেই পার্থক্যও তারা প্রেস কনফারেন্স গিয়ে ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা ভুলে যাওয়াকেই সাংবাদিকতা মনে করেছিলেন।
সুতরাং এমন সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকদের ‘লইয়া আমরা কী করিব’ এমন প্রশ্ন উত্থাপন হওয়া সঙ্গতই অপ্রাসঙ্গিক নয়। আর এমন সাংবাদিকদের যারা চাণক্য স্টাইলে আলাপ করেন, তাদেরকে প্রশ্নের বাইরে রাখাও সঙ্গত নয়। যারা চাণক্যের মতন ‘খাদ না মেশালে সোনা অলঙ্কারে পরিণত হয় না’, এমন থিওরি সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে চান, তাদের দাগের বাইরে রাখার সময় এসেছে। ৩৬ জুলাই আমাদের সেই বার্তাই দিয়ে গেছে।