ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে

নব্বইয়ের দশকে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কমবেশি সবাই বলিউডের মুভি দেখেছেন, গান শুনেছেন। ভরপুর বিনোদন হিসেবে কেউ কেউ হা করে গিলে খেয়েছেন গোবিন্দ কিংবা রাভিনা ট্যান্ডনদের মতো শিল্পীর উরুষ্টুঙ্গা নৃত্যের সম্মিলনে হওয়া গানগুলোকে। তাই তখনকার ট্রেন্ড ছিল চলচ্চিত্র যেমনই হোক, যেভাবেই হোক সেখানে নাচানাচির সঙ্গে ‘গা গরম করার মতো’ গান থাকা লাগবে। অনেক সময় কাহিনীর মিল না থাকাতে বাধ্য হয়ে পরিচালক সেখানে ‘আইটেম সং’ হিসেবে বিশেষ গান জুড়ে দিতে শুরু করেন। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, সুপার ফ্লপ চলচ্চিত্রের ‘আইটেম সং’ হয়ে গেছে সুপার ডুপার হিট।
এই দশকের শেষ দিকে আবির্ভাব হয় ইমরান হাশমির। আবেগঘন বিশেষ দৃশ্যে শরীরঘনিষ্ঠ অভিনয়ের পাশাপাশি তার সিনেমার গানগুলো হয় বিশেষ ধাঁচের। সেখানে গানের সঙ্গে নাচানাচি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নায়ক এবং নায়িকা দুজনেই নাচানাচি বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ঘ্যাঙর ঘ্যাং করতে থাকা কোলাব্যাঙেদের সেই আবহ! নায়িকা চুপচাপ কোথাও শুয়ে কিংবা বসে আছেন। ওদিকে ইমরান হাশমি তার পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছেন। এরপর শুরু হওয়া গানগুলো এতো বেশি ব্লকবাস্টার হিট হয়েছে, আগেকার শক্তিক্ষয় করা নৃত্যগীতগুলো নেহায়েত ঠুনকো মনে হয়েছে তার কাছে।
অভিমত লিখতে গিয়ে হুট করে এমন ভুতুড়ে উদাহরণ কেনো টানলাম! এর কারণ গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শিক বাস্তবতা। নব্বইয়ের দশকের নাচানাচির গানের মতো বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের নানা হঠকারি কর্মকাণ্ড মানুষের মনে দ্রোহ কিংবা প্রতিবাদ দূরে থাক, কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। ওদিকে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তার প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আত্মগোপনে যাওয়ার পরের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। এরপর যেকোনো ঘটনাই জনমনে ইমরান হাশমির গানের মতো উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।
আনসারদের বিদ্রোহ দিয়ে শুরু। তারপর যে যার জায়গা থেকে গুরু কিংবা মহাগুরু। কেউ কেউ যেমন ‘জার জার ওবস্তান তেকে’ পালিয়ে গেছেন, যারা লুকিয়ে আছেন তারা খেলা দেখিয়ে চলেছেন স্ব স্ব সক্ষমতা অনুযায়ী। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ, অচল এবং অপাঙক্তেয় প্রমাণে তারা কোনো ফাঁকফোকর রেখে কাজ করছে না। ফলাফল হিসেবে একের পর এক দ্রোহ, অস্থিরতা আর প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ উত্তাল করে রেখেছে বাংলাদেশকে। সেই সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই ধীরে ধীরে বিপ্লবের অংশীজনদের মধ্যে দৃরত্ব বাড়িয়েই চলেছে।
কার্যত একে অন্যকে হটিয়ে পলাতক স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া মসনদের কে কতটুকু দখল করতে পারে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চারদিকে। ফলাফল হিসেবে শিক্ষার্থীদের সংগঠন জানাক (জাতীয় নাগরিক কমিটি), ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামাত আর জাতীয়তাবাদনির্ভর রাজনীতি করা বিএনপি প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থান নিয়ে অতিরিক্ত সচেতনতা দেখাতে গিয়ে পরস্পর মুখোমুখি। এই সুযোগে বিপ্লবের অংশীজন হয়েও তারা পরস্পর নিজেদের সমালোচনা করতে যতোটা আগ্রহী; পলাতক স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রতিরোধ করা কিংবা তাদের করা গণহত্যার বিচারে আগ্রহ দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে তাদের অনেকের কাছেই। ওদিকে গণহত্যার বিচার নিয়ে শতফুল ফোটাতে চাইলেও জানাক অবাক করেছে সবাইকে। এক গণহত্যাকারীকে মুক্ত করার জন্য পুলিশকে চাপ দেওয়ায় তাদের এক সামনের সারির নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি আর চিরচেনা চারপাশ। সম্প্রতি প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রোহ আর বিপ্লবের সুর। সামান্য কিছুতেই প্রতিবাদ দেখে নবারুণের মতো বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে/ যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়’। সাত কলেজের নৈরাজ্য ধীরে ধীরে সমাধানের দিকে যেতেই হঠাৎ করে বেঁকে বসেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের ফ্যাসিবাদী আমলের সুবিধাভোগী কর্মচারী, কর্মকর্তা আর অংশীজনরা। শুধু বেঁকে বসেছে বললে ভুল হবে। এরা সরাসরি কর্মবিরতিতে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে পুরোদেশের রেল যোগাযোগ।
বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ঢাকার কমলাপুর থেকে শুরু করে সারাদেশের রেল স্টেশনগুলোতে ট্রেন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে হাজার হাজার যাত্রীকে। তারা বিভিন্ন স্টেশনে গিয়ে বিক্ষোভের পাশাপাশি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটিয়ে বসেছেন। কারণ আগে থেকে টিকেট করে রাখা বেশিরভাগ মানুষ জানে না ঠিক কী কারণে ট্রেন চলছে না। এমনি পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কী? তারা পুলিশ পাঠিয়ে উত্তেজিত যাত্রীদের আক্রমণ থেকে রেলস্টেশন রক্ষা করবে নাকি শাস্তির সম্মুখীন করবে রেলওয়ের উদ্ধত কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের যারা রেল যোগাযোগকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
ফ্যাসিস্ট শাসনামলে নানা অনৈতিক সুবিধা ভোগের পরেও রেলের স্টাফরা প্রায় চার বছর ধরে বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছিল। তখন সরাসরি চাকরি যাওয়ার ভয়ে তারা অনেকেই চুপচাপ থাকলেও এখন পুরোপুরি বেঁকে বসেছে? রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণায়লের চিন্তা একই রেখাতে মিলে না যাওয়ায় রেলওয়ের কর্মীদের দাবি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ওদিকে তারা মনে করছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় হচ্ছে ‘মামাবাড়ির আবদারের যুগ’। এই সময় শক্তভাবে আন্দোলন করা গেলে সব দাবিই পূরণ করা সম্ভব। অন্যদের দেখাদেখি তারাও নেমে পড়েছেন মাঠে।
প্রশ্ন উঠেছে, রেল মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিন আগে থেকেও শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি জেনেও কোনো উদ্যোগ না নিয়ে কেন রহস্যজনকভাবে নীরব ছিলেন? শুরুর নানা সমস্যা আমলে না নিয়ে এখন কি তাদের টনক নড়েছে? রেল কর্মীদের মূল দাবি বেতন-ভাতা-পেনশন নিয়ে। তাই রেল মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তের দায় ঠেলে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে। নানা দিক থেকে সংকটে থাকা অর্থ মন্ত্রণালয় একের পর করারোপ করে এমননিতেই বিপন্ন। নিজেদের সংস্কারের পাশাপাশি নানাবিধ অর্থপাচার ও চুরির ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তারা গলদঘর্ম। এজন্য তাদের ভাষায় ‘রেল কর্মীদের অযৌক্তিক দাবি’মেনে নিয়ে বেতন ভাতা বৃদ্ধির তেমন কোনো সুযোগ নেই।
রেলের স্টাফরা বহু আগে থেকে ধর্মঘটের ডাক দিলে অন্তত মন্ত্রণালয় থেকে দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট শাসনামলে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, জেল-জুলুম ও হয়রানির ভয় তাদের নীরব রেখেছিল। রেলের রানিং স্টাফ হিসেবে পরিচিত লোকো মাস্টার, সহকারী লোকো মাস্টার, গার্ড, ট্রেন টিকিট পরীক্ষকগণ দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করায় একটা সময় বেসিকের হিসেবে বাড়তি অর্থ তথা মাইলেজ পেতেন। হঠাৎ করে ২০২১ সাল থেকে তাদের সেই মাইলেজ কেটে নেওয়া হলেও তেমন প্রতিবাদ কেউ করতে পারেনি। তারা যে বেতন পাচ্ছিলেন তাতেই চুপচাপ দিন পার করে যাচ্ছিলেন।
প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। এ ছাড়া অবসরের পর মূল বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই সুবিধা ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর সীমিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময়ের পর নতুন করে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা পুরনোদের চেয়ে আরো কম সুবিধা পাবেন বলেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে রানিং স্টাফরা বলে আসছেন, তারা এটা মানবেন না। মানলে তারা ওভারটাইম করবেন না। যেখানে ডিউটি টাইম ৮ ঘণ্টা পূর্ণ হবে সেখানেই তারা নেমে যাবেন।
শুরুর দিকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামগামী এক ট্রেন থেকে মাঝপথে রানিং স্টাফরা নেমে গিয়েছিলেন। তখন যাত্রীরা বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। তখন সে ট্রেনের যাত্রী ছিলেন আওয়ামী সরকারের একজন মন্ত্রীও। শুরুতে চাকরি খেয়ে নেওয়ার হুমকিধামকি দিলেও রানিং স্টাফদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। তারপর চার বছরেও এর কোনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। তাই পরিস্থিতি অস্পষ্ট থেকে এখন পুরোপুরি ঘোলাটে। ঘোলা পানি দেখে সুযোগ বুঝে মাছ শিকারে নেমে গিয়েছেন অনেক সুযোগ সন্ধানী। আর তাতে করে যাই হোক, বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে গিয়ে পদে পদে হোঁটচ খেতে থাকা বর্তমান সরকার নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আবার বিব্রত হয়েছেন।
বাংলাদেশে রেলওয়ে বহুদিন আগে থেকেই স্থবিরতা আর অনিয়মের এক অন্ধকূপ। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দায়িত্ব নিয়ে ‘রেলওয়ের কালো বিড়াল’ বের করার আশ্বাস দিয়ে নিজেই দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’ হিসেবে ধরা পড়ে সরে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দায়িত্ব থেকে। ওদিকে এরপর যে যারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, প্রত্যেকেই হয়েছেন কমবেশি বিতর্কিত। ফলাফল হিসেবে পুরো রেলওয়ে বহুদিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাই তারা গর্জে উঠে পুরো সিস্টেমকেই অকেজো করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রে পুরো ভঙ্গুর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিগত দেড় দশকের লুঠপাট, অনিয়ম আর অপশাসনে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে সহসা তার থেকে মুক্তি মিলছে না। এজন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়গুলোর মোকাবেলা করতে হবে। বিদ্যমান সমস্যাগুলো থেকে বড় কোনো জট তৈরির আগেই তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। একটা বিষয় বর্তমান সরকারকে বুঝতে হবে যে ফ্যাসিবাদ পতনের পর কিছু না হোক সবার মন থেকে ভয় চলে গেছে। তারা কিছু না করুক অন্তত প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। এজন্য যাই হোক, অন্তত কোনো অনিয়ম আর অবিচার দেখে তারা চুপ থাকবে না। বর্তমান সরকার যাই করতে চেষ্টা করে, তার আগে এই বিষয়টি আমলে নিয়েই করতে হবে। কবি নবারুণের সেই কবিতায় ভয়ের ফ্যাকাশে মুখকে যেমন অচেনা বলা হয়েছে। এখন ঠিক সেই সময়। তাই সময়ের দাবি মেনে জনতাকে আমলে নিয়েই কাজ করতে হবে। নচেৎ এমনি নানা প্রতিবাদ, দ্রোহ আর তার ধারাবাহিকতায় ভয়াবহ স্থবিরতা থেকে মুক্তির পথ খুবই সংকীর্ণ হয়ে আসছে প্রতিটি দিন।