Logo
Logo
×

অভিমত

শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমাদের কুশীলব এবং সীমান্তের বার্তা

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩০ পিএম

শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমাদের কুশীলব এবং সীমান্তের বার্তা

ইসলাম অবমাননার দায়ে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে কারাদণ্ড দিয়েছে বৌদ্ধ অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কার আদালত। গণমাধ্যম জানাচ্ছে, গ্যালাগোডাত্তে জ্ঞানাসরা নামের ওই বৌদ্ধ ভিক্ষু এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতন কারাগারে গেলেন ইসলাম বিদ্বেষের কারণে। ইসলাম বিদ্বেষ জাতিসংঘ স্বীকৃত অপরাধ। ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে খোদ জাতিসংঘ ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে টু কমব্যাট ইসলামোফোবিয়া’ নামে একটি দিবসের ঘোষণা দিয়েছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘ দিবসটি ঘোষণা করে এবং প্রতিবছর ১৫ মার্চ দিবসটি পালিত হবে বলে জানায়। ২০২৩ ও ২৪ সালে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হলেও মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশ দিবসটি পালন করেনি। ফ্যাসিস্ট রেজিম করতে দেয়নি। জানি না, ফ্যাসিজম পরবর্তীতে দিবসটি এ বছর পালিত হবে কিনা। 

চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ নিয়ে বাংলাদেশে তুলকালাম ঘটে গেল। বাংলাদেশের চেয়ে আরও বেশি তুলকালাম ঘটালো উগ্রপন্থি বিজেপির নিয়ন্ত্রণাধীন ভারত। শ্রীলঙ্কা তাদের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে কারাগারে পাঠিয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম বিদ্বেষের কারণে। আমাদের দেশে ইসলাম বিদ্বেষ নতুন নয়। সারাবছরই কেউ না কেউ ইসলাম নিয়ে মেতে আছেন। কোথায় কোথায় ইসলামের ত্রুটি, কোন কারণে ইসলামিস্টরা উগ্রপন্থি, সেসব প্রমাণে উদগ্রীব তারা। এরা আবার নিজেদের মানবতাবাদী, সংস্কৃতিজন, বুদ্ধিজীবী নানান পরিচয়ে প্রচারণা চালান। প্রচারণা বললাম এই কারণে যে, প্রচারে সত্যটা থাকে, প্রচারণায় থাকে সত্য ঢাকার প্রয়াস। মূলত এরা এসব পরিচয়ের আড়ালে প্রতিজনই ফ্যাসিজমের অনুসারী।  

কেন বললাম ফ্যাসিজমের অনুসারী, কারণ, এরা দীর্ঘদিন এই ইসলাম বিদ্বেষের নামে ফ্যাসিজমকে শক্তি দিয়েছে। এদের কারণেই জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে ব্লগারদের ফ্যাসিজমের মদতে, দোষ পড়েছে ইসলামিস্টদের ওপর। ফ্যাসিস্টদের পতনের পরও এরা সেই কার্ডই খেলতে চেয়েছিল রাজনৈতিক খেলায়। চেষ্টা করেছিল সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করতে। যার ফলেই ভারত এবং বাংলাদেশের প্রোপাগান্ডা মেশিন সেই সব খবরই উৎপাদন করেছে, যার মাধ্যমে সম্প্রীতি বিনষ্ট করে একটি দাঙ্গা লাগানো সম্ভব হয়। হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই তারা বাদ রাখেনি। 

সেই প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় তুরুপটা হলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ। খোদ ইসকন যার বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে, সেই চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে মাঠে নামিয়ে ভয়াবহ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা ছিল, যা রুখে দিয়েছে এদেশের সম্প্রীতির পক্ষে থাকা মানুষ। কিন্তু তারপরেও থেমে থাকেনি ভারতীয় গণ ও সামাজিক মাধ্যমের প্রোপাগান্ডা। রিপাবলিক বাংলা, এবিপি আনন্দ, আনন্দবাজারসহ ভারতীয় ‘গদি মিডিয়া’ থেমে থাকেনি। আজগুবি সব প্রচার চালিয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। না, উদাহরণ দিতে চাইছি না, এ কাজ দেশ-বিদেশের অনেক গণমাধ্যম আগেই সেরে রেখেছে। জানিয়েছে, ভারতের এসব খবর ফেইক। কিন্তু ‘চোরে না শোনে ধর্মে কাহিনী’। 

আবার চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের কথায় ফিরি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা ধর্ম বিদ্বেষের চেয়ে গুরুতর এবং তা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। একটা রাষ্ট্র ধর্মের ঊর্ধ্বে। কারণ এখানে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় তারা নাগরিক। রাষ্ট্র তাদের পরিচয়, ধর্ম নয়। আমরা মুসলমান বা হিন্দু অথবা অন্য যেকোনো জনগোষ্ঠীর হই না কেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় হলো বাংলাদেশি। সৌদিআরবে প্রায় সবাই মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরিচয় রাষ্ট্রের পরিচয়ে। 

নেপাল হিন্দুরাষ্ট্র হলেও তাদের পরিচয়ও রাষ্ট্রই বহন করে। তারা নেপালি। সুতরাং চিন্ময় কৃষ্ণের অপরাধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। শ্রীলঙ্কায় যদি ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর শাস্তি হয়, তবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে কেন শাস্তি দেয়া যাবে না, প্রশ্নটা রইলো, উত্তর আপনাদের কাছে। 

এখন আসি আমাদের দেশের কিছু ইসলামিস্টদের বিষয়ে। সেক্যুলারদের একটি অংশ যেমন ব্যক্তিস্বার্থে ফ্যাসিজমের অনুসারী হিসেবে নানান বিষয়ে উস্কানি দেয়, তাতে সেই ইসলামিস্টরা ফুঁসে ওঠে মাঠে নেমে পড়েন। তারা একবারও ভাবেন না তাদের মাঠে নামানোর জন্যই এই উস্কানি। তারা যেন মাঠে নেমে তাণ্ডব চালান এবং তাণ্ডবকে জঙ্গিবাদের উত্থান হিসেবে সারাবিশ্বকে দেখানো যায়, সেই উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিজমের অনুসারী সেক্যুলারদের উস্কানি। এটুকু ধরতে ব্যর্থ হন সেই আগবাড়িয়ে মাঠে নেমে যাওয়া ইসলামিস্টরা। তাতে ফল হয় উল্টোটা। 

এবার চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ডে সারাদেশের মানুষ যেভাবে নিজেদের সামলেছে, সম্প্রীতি রক্ষা করেছে, তা প্রমাণ করে দিয়েছে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মুসলমানরা উগ্রপন্থি নয়। অথচ বিপরীত ঘটনা ঘটলে কী হতো, সারাবিশ্ব দেখতো বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রতিশোধ পরায়ণ। ভারতের মিডিয়ার হাতে মোক্ষম অস্ত্র চলে আসতো, রাম-পাঁঠা ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের নর্তন-কুদন বেড়ে যেতো ভয়াবহ ভাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্ম ও সম্প্রীতিপরায়ণ মানুষ তা হতে দেয়নি। 

কিন্তু তারপরেও থেমে আছে কি ষড়যন্ত্র? নেই। হিন্দুদের সাথে ঝামেলা না লাগাতে পারায় সেই সীমান্ত ওপারের ও তাদের অনুসারী এপারের শক্তি মাঠে নেমেছে ইসলামিস্টদের বিভক্ত করার কাজে। তারা সফলও হয়েছে। না হলে, টঙ্গির ইজতেমার মাঠে হত্যাকাণ্ডের মতন নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটতো না। বিভক্ত হতো না দেশের ইসলামিস্টরা। মাজার ভাঙার সিরিয়াল ঘটনা ঘটতো না। বিভেদ লেগে থাকতো না বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর মধ্যে। 

কেন এই বিভেদ তা ছোট করে বলি। জিয়াউর রহমানের সময় নির্বাচন হলো। জামায়াত সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কারণ তারা দলই গোছাতে পারেনি সে সময়। জামায়াতের উত্থান মূলত আওয়ামী লীগের সাথে মিলে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে। এর আগে নির্বাচন হয়েছে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ও প্রো-আওয়ামী লীগের মধ্যে। অ্যান্টি আওয়ামী লীগ মানে বিএনপি এবং প্রো-আওয়ামী লীগ মানে আওয়ামী ও তাদের লেজুরগণ। কিন্তু সেখানে ভোটের অনুপাত ছিল পুরোপুরি অ্যান্টি-আওয়ামী লীগের পক্ষে। যে অনুপাতের হিসেবে ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা কখনোই সম্ভব ছিল না। 

পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র যখন এই সত্যটা বুঝতে পারলো এবং দেখতে পেলো ভোটের আনুপাতিক হিসেব ভাঙতে হবে। তখন তারা ভাঙন পর্ব শুরু করলো। বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সেই পর্ব শুরু হলো। বিএনপিকে ভাঙা হলো। জাতীয় পার্টিকে সৃষ্টি করা হলো। ইসলামী দলগুলোকে টুকরো টুকরো করার কাজ চললো। 

বিএনপি থেকে ইসলামী শক্তিকে আলাদা করার জন্য চর ঢুকানো হলো। অরাজনৈতিক ইসলামী শক্তিগুলোকেও নানান ফেরকায় বিভক্ত করে দেওয়া হলো। কিন্তু তারপরেও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন সৃষ্টি করা হলো ওয়ান-ইলেভেনের। তারপরের চিত্র তো সবারই জানা। কীভাবে প্রতিটা রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছিল। চলছিল হত্যা-গুমের মহামারি। আর সেটা রুখতেই জুলাই চব্বিশের বিপ্লব। 

কিন্তু বিপ্লবেরও পরও কি সেই বিভক্তের ষড়যন্ত্র থেমে আছে? না। সেই আগের কুশীলবরাই আবার মাঠে নেমে পড়েছে। বিপ্লব ও বিপ্লবীদের প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজ চলছে। অগণিত তরুণের আত্মত্যাগকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। চব্বিশের শহীদদের খাটো করার জন্য আমদানি করা হচ্ছে অযথা বিতর্কের। একাত্তরকে চব্বিশের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছেকৃত ভাবে। অথচ চব্বিশ এসেছে একাত্তরের ধারাবাহিকতাতেই। একাত্তরের অর্জন আমরা ধরে রাখতে পারেনি, তা ব্যবহার হয়েছে লুটেরাদের পুঁজি হিসেবে। একাত্তরকে লুটেরারা ব্যর্থ করতে চেয়েছে। সেই একাত্তরের চাওয়াকে পূরণ করতেই চব্বিশের বিপ্লব। 

বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম হিসেবে আবার পরিচয় করিয়ে দিতেই সেই বিপ্লব। যাকে কেউ কেউ অভ্যুত্থানের নামে ছোট করতে চায়। করতে চায় নিজেদের না পারার ব্যর্থতায়। এই ব্যর্থদের কথা ধরলে দেশ আবার পিছিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট আর নওগাঁ সীমান্তে জানান দিয়েছে স্বাধীন এই দেশকে পদানত করা যাবে না, পিছিয়ে দেওয়া যাবে না। একসময় যেমন জানান দিয়েছিল পদুয়ায়। তারা পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে ওপার-এপারের কুশীলবদের বাংলাদেশ পরাভব মানার নয়। একাত্তরেও মানেনি, চব্বিশেও মানেনি, ভবিষ্যতেও মানবে না। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন