পতিত হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের অন্যতম অভিযোগ ছিল দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা। জুলাই মাসে দরিদ্র মানুষদের একটা বড় অংশ রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের কারো কারো কথা ছিল যে, এই অসহনীয় দ্রব্যমূল্য কমাতে না পারলে জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ছে, আর তাই জীবনবাজি রেখেও এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে।
সরকারের পতন হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসলেন পাঁচ মাস হয়ে গেছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সামান্য সাফল্য এলেও এখনও বাজারে গেলে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। তবে, সরকারের সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা ও আশঙ্কা বয়ে এনেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন, ব্যবসায়ীসহ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারির জন্য উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রতি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সূত্র ধরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, এই অধ্যাদেশ জারি হলে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে। এর মধ্যে মুঠোফোনের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ, সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ, এলপিজি গ্যাসের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হবে। যেসব রেস্তোরাঁয় বর্তমানে ৫ শতাংশ এবং হোটেলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। তৈরি পোশাকের ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
এভাবে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে আরও দাম বাড়বে গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, এইচআর কয়েল, সিআর কয়েল, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, টয়লেট টিস্যু, মিষ্টি, গাড়ির ওয়ার্কশপ, তাজা-শুকনা সুপারি, ফলের রস, তাজা ফল, সাবান-ডিটারজেন্ট, রং, সিগারেট, বিমানের টিকিট ইত্যাদি।
বর্তমানে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্নওভার বা বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে তার জন্য ৪ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকা, অর্থাৎ দৈনিক বিক্রি গড়ে ১৩ হাজার ৬৯৮ টাকা পার হলেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় চলে আসবে।
এই সমস্ত কিছুর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি হুহু করে বাড়বে। এই বাড়তি ভ্যাটের বোঝা বইতে হবে ভোক্তাকে।
সবচেয়ে বিরক্তিকর ও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও পতিত সরকারের মন্ত্রীদের ভাষায় কথা বলছেন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সেই ছাড়টা দেখবেন।’
তবে বাস্তবে চাল, আলু, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ইত্যাদি নিত্যপণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হলেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। মোবাইল ও ওষুধ সেবার মতো জরুরি পণ্যরও দাম বাড়ছেই। শুল্ক ছাড়ের সুবিধা কতটা সাধারণ মানুষ পেয়েছে, আর কতটা ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকেছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভোক্তাদের ওপর ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়ার একটা বড় কারণ সরকারের কর আদায়ের ব্যর্থতা, বিশেষত বড় করদাতাদের থেকে কর না নিতে পারা।
সিপিডির এক গবেষণা অনুসারে, দেশে করযোগ্য আয় করেও ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকি ও কর এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়।
শুধু তাই নয়, বিগত আমলে আওয়ামী সুবিধাভোগীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। এখনও পর্যন্ত, দেশে ও বিদেশে থাকা এসব লুটেরাদের বিচার বা অর্থ উদ্ধার করা যায়নি। এইসব অর্থ উদ্ধার করা গেলে দেশের জনগণের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করতে হতো না।
অথচ, সরকার সেই পথেই হাঁটছে। সরকারের এহেন পদক্ষেপ দেশ ও জনগণকে বিপদ্গ্রস্ত করে তুলছে।