আলাদা আলাদাভাবে কাঙ্গিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা দিতে কেবল যে বিপুল অঙ্কের পরীক্ষার ফিস দিতে হয় তাই না, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাতায়াত বাবদ ছাত্র-ছাত্রীদের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, যা দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের জন্য প্রায়শই জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ধরা যাক, পঞ্চগড় থেকে একজন ছাত্রী ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চান। কি পরিমাণ যাতায়াত ভাড়াই শুধু তাঁকে খরচ করতে হবে! আর সেই শহরে একদিন আগে গিয়ে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আরও একগাদা পয়সা খরচ করতে হবে। তা না পারলে, ক্লান্তিকর একটি ভ্রমণ (পয়সার অভাবে সস্তার বাসে বা ট্রেনে) শেষে তাঁকে পরীক্ষায় বসতে হবে। এই ব্যাপারটি তাঁকে পয়সাওয়ালা প্রার্থীদের থেকে পিছিয়ে দেবে। যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।
এই ভোগান্তি লাঘব করার জন্য, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথমে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হয় কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর থেকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। এছাড়া দেশের ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (জিএসটি) বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছিল।
ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আলাদাভাবে পরীক্ষা নেয়। তবে গুচ্ছে না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি অনেকটাই কমাতে পেরেছে।
কিন্তু আসন্ন ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি সামনে রেখে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এককভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই পথ অনুসরণ করতে চায় আরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব আইন, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ও স্বকীয়তার কথা বললেও বাস্তবে আর্থিকভাবে বিপুল লাভের কারণেই মূলত আলাদা পরীক্ষা নিতে চায়। কারণ, ভর্তির ফরম বিক্রি বাবদ বিপুল আয়ের বড় অঙ্কই শিক্ষকসহ ভর্তির কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পেয়ে থাকেন।
এবছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রাথমিকভাবে মোট ১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৩৪ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। প্রাথমিক আবেদন ফি নেওয়া হয় শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ টাকা। শুধু প্রাথমিক আবেদন ফি হিসেবেই প্রায় ২ কোটি টাকা আয় করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখন চলছে চূড়ান্ত আবেদন পর্ব। চূড়ান্ত আবেদনের জন্য শিক্ষার্থীপ্রতি ৭০০ টাকা ফি দিতে হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রতি ইউনিটে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এই কারণে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যার ভাগ পাবেন শিক্ষক, কর্মচারীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন কারণ দেখালেও, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা এই অর্থের ভাগ ছাড়তে রাজি না। এই কারণে তাঁরা গুচ্ছ পদ্ধতি ভেঙ্গে দিতে চাইছে।
অথচ প্রায় তিন দশক ধরে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে একই ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। পরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। এর ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান কমে গেছে বলে শোনা যায়নি কখনো।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিপুল বৈষম্য বিরাজ করছে যা একদিনে ঠিক হবে না, কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাদ দিয়ে গরিবের ছেলেমেয়েদের জন্য পরীক্ষা বিষয়টাকে অসম্ভব করে তোলার মতো পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থে লাখো লাখো মেধাবী, তথা দেশের ভবিষ্যতের বঞ্চিত করা যাবে না।