ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ কি প্রথমটির ধারাবাহিকতা হবে?
হাসান উরীদ
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১০ পিএম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তাদের বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে এই নির্বাচন বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক মার্কিন নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিশেষত বর্তমান অশান্ত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত, বৈশ্বিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক মন্দার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা পুনঃপ্রাপ্তি অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। বিশেষ করে সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে রিপাবলিকান পার্টির আধিপত্যের কারণে। প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসন কি তার প্রথম মেয়াদের ধারাবাহিকতা হবে? কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন, দ্বিতীয়বারে ট্রাম্প সম্ভবত প্রথম মেয়াদ থেকে ভিন্নভাবে কাজ করবেন। প্রথম মেয়াদে তার প্রচারণা ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু বাস্তবে তিনি মূলত ধনীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করেছিলেন। এবার হয়তো তিনি ‘প্রভাবশালী সরকারি বিভিন্ন সংস্থার’ সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন।
ট্রাম্পের রাজনীতি ও তার জনপ্রিয়তা মার্কিন সমাজের একটি বিশেষ চাহিদা ও পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এটি পপুলিজমের এক উদাহরণ, যা ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিশাল ভোটসংখ্যার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিল। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড এবং কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও প্রায় ৭৩ মিলিয়ন ভোট পাওয়া প্রমাণ করে যে, ট্রাম্পবাদকে মার্কিন জনগণ এখনও সমর্থন করে। ট্রাম্প ব্যক্তি হিসেবে পরাজিত হলেও, ট্রাম্পবাদ পরাজিত হয়নি। সাম্প্রতিক নির্বাচনে তার ফিরে আসা এরই প্রমাণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পপুলিস্ট চাহিদা মূলত সেসব শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের ভয় ও চাহিদার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, যারা তাদের পরিচিতি ও সংস্কৃতির অবনতি বা পরিবর্তনের শঙ্কা অনুভব করেন। অভিবাসন কমানো এবং আর্থ-সামাজিক সুরক্ষাবাদ তাদের মূল চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে। ট্রাম্প এই গোষ্ঠীকে আশ্বস্ত করেছেন যে তাদের মর্যাদা এবং ‘বিশুদ্ধতা’ বজায় থাকবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পপুলিস্ট প্রবণতা ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পপুলিস্ট চাহিদা আমেরিকান সমাজের ভিত্তিতে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। এটি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকাকে আবার শক্তিশালী করি’ ধরনের স্লোগানগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই পপুলিস্ট ধারণাগুলো নতুন করে উত্থান পাচ্ছে, যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইউরোপসহ অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাগুলোকেও প্রভাবিত করবে।
বিপরীতে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার শপথ গ্রহণের সময় গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জোর দেন। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে, যা শক্তিশালী রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়ক, সেই অবস্থানও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতা যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত ও বৈশ্বিক উত্তেজনার মধ্যেই ট্রাম্পের সম্ভাব্য দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হবে। এই যুদ্ধগুলো বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ট্রাম্প সাধারণত বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি অনুসরণ করলেও নতুন এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হতে পারে।
AUKUS এবং QUAD জোট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী ন্যাটোর নতুন চাহিদাগুলোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি অটুট থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে যে ব্যাপক সম্পৃক্ততা দেখিয়ে আসছে, তা ট্রাম্প প্রশাসনে কিছুটা কমতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্পের প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যা তিনি বিশ্বাস করেন ২০২০ সালের নির্বাচনে তার বিজয় ‘চুরি’ এবং বিচারিক বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তার এই প্রতিশোধ প্রবণতা তাকে ডেমোক্রেটিক পার্টি, উদারপন্থী গোষ্ঠী ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানে নিয়ে আসতে পারে। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যারা তার প্রতিপক্ষের পক্ষে ছিল তাদের ওপর তার অসন্তোষ প্রভাব ফেলতে পারে।
যদিও ট্রাম্পের অধীনে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আশা করা কঠিন। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন, গাজা ও চীন সম্পর্কিত ইস্যুগুলিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ যুদ্ধের পরিণতি হিসেবে যদি রাশিয়া ডনবাসের দখল নিয়ে নেয় এবং ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরাজয় হিসেবে গণ্য হতে পারে, যা ট্রাম্প সহজেই মেনে নিতে পারবেন না।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন নীতির মধ্যে আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের গুরুত্ব অপরিবর্তিত থাকতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মেরুদণ্ড হিসেবে থেকে যাবে। গাজার পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। বিশেষ করে যেসব আরব দেশগুলোর সহায়তায় পুনর্গঠনের কাজ করা সম্ভব। তবে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের সম্ভাবনা কম।
নতুন প্রশাসন লেবাননের বিষয়গুলো পুনর্গঠনে উদ্যোগী হতে পারে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা করতে এবং লেবাননকে ‘পশ্চিমা প্রভাবের’ অধীনে পুনরুদ্ধার করতে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মোকাবিলায়, সামরিক সংঘাত ছাড়াই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বহিরাগত বিরোধিতা ব্যবহার করে বেশি চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে। যা ইরানের ক্ষমতায় ফাটল ধরাতে এবং সামগ্রিকভাবে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে।
চীনের ক্ষেত্রে, নাটকীয় পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে, দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন পূর্ব এশিয়ায় তাইওয়ান ইস্যুতে আরও বাস্তববাদী অবস্থান নিতে পারে এবং আমেরিকান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারে।
ইউরোপের ক্ষেত্রে, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্গঠন হতে পারে। ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে এবং ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যকার লুকানো উত্তেজনা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। ইউরোপের জন্য সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে আমেরিকান সহায়তার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
একটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। এই বৈশিষ্ট্যটি এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে বড় সংঘাতের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
আল জাজিরা এরাবিক অবলম্বনে, মূল: হাসান উরীদ, ভাষান্তর: মুহাম্মাদ শোয়াইব