বিএনপির একজন সমর্থক ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, ‘বিএনপির সমর্থক হিসেবে আমি গর্বিত, কারণ ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪ প্রতিটি মুক্তিই আমাদের গর্বিত করে।‘ এই গর্বিত সমর্থকের বক্তব্যর যে ওজন তা খোদ দলটির নীতিনির্ধারকরা বোঝেন কিনা সন্দেহ। বুঝলেও তাঁরা কতদূর তা ধারণ করেন তা সন্দেহ জাগায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসন চালিয়েছে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এই সময়ে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ায়সহ দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। জনগণের ভোট না থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থনে ছিল আমলা, পুলিশ বাহিনী আর এর সম্মতি উৎপাদন করে গেছে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলতে একমাত্র আওয়ামী লীগকেই বুঝিয়ে, এর বিপরীতে যারাই কথা বলেছে তাঁদেরই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে এই গোষ্ঠী।
সবচেয়ে বেশি খড়গের নিচে ছিল বিএনপি। এই দলটির প্রতিষ্ঠাতাসহ বিভিন্ন নেতারা ৭১ সালের যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, ৯০ এর গণ-আন্দোলনে আপোষহীন ভূমিকার কারণে ৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ত্বাধীন দলটি জনগণের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। সেই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে, আওয়ামী বয়ানের প্রচারযন্ত্র সেই ঘটনাকে উপেক্ষা করে ২০০১ সালের নির্বাচন এবং এরপর জামায়াতের সাথে বিএনপির জোট করাকেই বড় করে দেখিয়েছে। বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল বানিয়ে জামায়াত-বিএনপি শব্দ যুগল একসঙ্গে উচ্চারণ করেছে।
শুধু তাই না, বারবার প্রচার করা হয়েছে যে বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া দল, ক্ষমতার অনুগ্রহে তৈরি হওয়া দল, এই দলের নেতা-কর্মীদের কোনো ত্যাগ তিতিক্ষা নেই। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে বলা হতো যে, এই দলটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর ২১ বছর তাঁরা লড়াই সংগ্রাম করেছে। জনমনে এই বিশ্বাস উৎপাদন করেছে যে বিএনপি সুবিধাবাদীদের দল আর আওয়ামী লীগ ত্যাগীদের দল।
অথচ এরশাদ আমলে, হাসিনা বারংবার স্বৈরাচারের সাথে হাত মিলিয়েছে, ৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, নূর হোসেনদের রক্তের সাথে বেইমানি করেছে। কিন্তু, খালেদা জিয়া ও বিএনপি তা করেনি। তবে, বিএনপির জন্য অগ্নিপরীক্ষা ছিল ২০০৮ সালের পর থেকে। কেবলমাত্র সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচার নয়, এই সময় থেকে বিরোধী মত ও দল দমনের অবিশ্বাস্য নির্মমতা দেখে বাংলাদেশ। গুম, খুন, বিভিন্ন রকম আইনি হেনস্থার অকল্পনীয় অত্যাচারের শিকার হয় বিরোধীরা। বিভিন্ন স্তরের বিএনপি কর্মীদের জন্য এই যুগটা ছিল টিকে থাকার এক অসম্ভব লড়াই। অবশেষে ২০২৪ সালে স্বৈরাচারের পতন হয়। প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপি গৌরবের সঙ্গে টিকে থাকে। আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে এই দলটার নেতা-কর্মীরা নিজেদের শক্তিমত্তা ও বিশ্বাসের প্রমাণ দেয়।
শুধু তাই না, আওয়ামী সরকারের পতনের পর দলটির উচ্চপর্যায়ের নেতারা ধৈর্য ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রান্ত থেকে, এমনকি খোদ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দলটিকে নিয়ে উষ্মা দেখালেও তাঁরা এর বিপরীতে হঠকারিতা করেনি। মিডিয়া ও সুশীল সমাজের নানা অংশ -বিএনপি আর আওয়ামী লীগ একই- এই বয়ান দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা করলেও আপাতদৃষ্টিতে দলটি গণতন্ত্র এবং দেশ পুনর্গঠনে আন্তরিকতার পরিচয় দিচ্ছে।
ছোট করে জামায়াতের ব্যাপারে একটু কথা বলতে হয়। আওয়ামী লীগের প্রথম কয়েক বছর এই দলটির নেতা-কর্মীরা নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়। তবে একটা পর্যায়ে দলটির নেতা-কর্মীরা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। তাঁদের একটা বড় অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের সাথে মিশে যায়। আওয়ামী অরাজকতার অংশ হয়।
অভিযোগ আছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা জায়গা থেকে তহবিল পাওয়া, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দলটি অর্থের বিনিময়েও এই মিশে যাওয়ার কাজটি করে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, নীতিহীন আওয়ামী নেতারা অর্থের লোভে সহজেই তাদেরকে আত্তীকরণ করে নেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর এই ব্যাপারগুলো প্রকাশ্য হয়। অর্থাৎ, সুবিধা নেওয়া জামায়াত প্রশাসনসহ বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে নিজেদের লোক বসাতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতিতে এই চতুরতা নেই। তাঁরা দলের ব্যানারের নিচে থেকে নির্মম অত্যাচারের শিকার তো হয়ই, বিগত দেড় দশকে শক্তিশালী অবস্থানে তাদের নেতা-কর্মীরা পৌঁছাতে পারে না। অন্যদিকে আওয়ামী বয়ান ভাঙ্গতে যে শক্তিশালী সুশীল সমাজ ও মিডিয়া দরকার, বিএনপি দলগতভাবে তা করতে ব্যর্থ হয়।
সৌভাগ্যক্রমে, আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী বিরোধীরা সামাজিক মাধ্যমে দলটির বয়ান ভাঙতে শুরু করে। বিপুল পরিমাণ ক্ষুব্ধ মানুষ, বিশেষত তরুণদের কাছে আওয়ামী ভণ্ডামি উন্মোচিত হয়। আর মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নির্মমতা আরও বাড়তে থাকায় এই ক্ষোভ আকাশে ওঠে। বলাই বাহুল্য, বিএনপি কর্মী সমর্থকদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা মাঠ পর্যায়ে এই ক্ষোভকে বহন করে নিয়ে যায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় জুলাই আন্দোলনে, যখন ব্যানারহীন আন্দোলন হলেও বিএনপির কয়েক শতাধিক কর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েক সহস্র। আমজনতার আন্দোলনে মিশে গিয়ে দলটি জনতার চেতনার সাথে এক হয়ে যায়।
কিন্তু, কেবলমাত্র জনগণের শক্তি দিয়েই রাজনীতি আর ক্ষমতার সমীকরণ মেলে না। হাসিনার পতনের পর বিএনপিকে নিয়ে যে বিরোধিতা, আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে এক পাল্লায় ফেলার যে প্রবণতা তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান ও বয়ান তৈরির ব্যর্থতা স্পষ্ট।
এর কারণ বিএনপির শক্তিশালী মিডিয়া নেই যারা বয়ান তৈরি করবে। প্রতিনিয়ত জনসমর্থন আদায় ও সম্মতি উৎপাদন করবে। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া উভয়েই মধ্যমপন্থী রাষ্ট্রনেতা ছিলেন। তাঁদের দলে সব মতের মানুষ ছিল, সংস্কৃতি ও বয়ান তৈরিতে অগ্রসর থাকা মিডিয়া ব্যক্তিরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বামপন্থী সংগঠনের তরুণ ও তাত্ত্বিকরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ডানপন্থীরাও। কিন্তু, সেই ভারসাম্য, সেই শক্তি এখন দলটির মধ্যে প্রতীয়মান হয় না।
দীর্ঘ লড়াইয়ে বিএনপি প্রমাণ দিয়েছে তাঁরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে এবং মাঠে থাকে। কিন্তু, বয়ান তৈরির ‘সফট’ পাওয়ার না থাকা দলটির একটি বড় দুর্বলতা।