যে চার উপায়ে আ.লীগ আমলে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনা যেতে পারে
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাজেট সহায়তার জন্য প্রায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিতে বাধ্য করে।
ঠিক ওই সময়েই যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে আহমেদ রহমান নামে এক ঘড়ি সংগ্রাহককে নিয়ে একটি ফিচার স্টোরি প্রকাশ করে। আর এই আহমেদ রহমান হলেন শেখ হাসিনার ক্ষমতাধর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ভাতিজা। সালমান এফ রহমান এখন কারাগারে আছেন।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত ওই খবরে উল্লেখ করা হয়, ব্যয়বহুল ঘড়ি সংগ্রহ ছাড়াও আহমেদের পরিবার যুক্তরাজ্যে মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের অনেক সম্পত্তি আছে। এর আগে নেত্র নিউজ নামে এক নিউজ সাইটে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে রহমান পরিবারের একটি বাড়িতে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা বসবাস করেন।
বাংলাদেশের আইনে বিদেশে অর্থ স্থানান্তরে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও আহমেদ পরিবার এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর করেছেন সেই ধাঁধা রয়েছে গেছে।
যদিও জনগণ এটা খুব ভালো করেই জানেন যে বাংলাদেশে হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শাসকগোষ্ঠী বিদেশে অর্থ পাচারে অন্ধকার অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। উদাহরণ হিসেবে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধান ডেস্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বাইরে হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের সম্পদ রয়েছে। আর এই বিপুল অর্থের বেশিরভাগই পাচার করা।
হাসিনার পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বাংলাদেশের চুরি যাওয়া সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনা দরকার।
অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে ইউনূস সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আর্থিক খাতের সংস্কার বাস্তবায়নে বিতর্কিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা বোর্ডে রদবদল এনেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের কোষাগার চাপের মধ্যেই রয়েছে।
তাই ঋণ চাওয়ার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উপায় খুঁজতে হবে। যা দেশের অর্থনীতিকেই শুধু চাঙ্গা করবে না, ঋণের বোঝা কমাতেও সাহায্য করবে। চারটি উপায়ে বাংলাদেশ তার চুরি যাওয়ার সম্পদ ফিরিয়ে আনতে পারে। চারটি উপায় হলো:-
প্রথমত, বাংলাদেশ স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি ইনিশিয়েটিভের (StAR) সদস্য। এটি বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপ এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) মধ্যকার অংশীদারিত্বভিত্তিক সংস্থা। কিন্তু সংস্থাটির পুরো সুবিধা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। কারণ হাসিনা সরকার এটিকে সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেয়ে বরং বিরোধী নেতাদের হয়রানিতে ব্যবহার করেছে। এই সংস্থার অধীনে যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশকে প্রায় এক দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত পেতে সাহায্য করেছিল।
দ্বিতীয়ত, সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে, তাদের সম্পদ জব্দ করতে এবং তাদেরকে বাংলাদেশের ফিরে এসে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বের অন্যান্য সরকারগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারে।
তৃতীয়ত, পাচারকৃত অর্থ যদি মার্কিন অর্থ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বা লেনদেন করা হয়ে থাকে তবে আমেরিকার ফরেন কারাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট (এফসিপিএ) গেম চেঞ্জার হতে পারে। ফিফা দুর্নীতি স্ক্যান্ডাল থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে এবং আমেরিকায় বসবাস করা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের ওপর সেই জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে। এক্ষেত্রে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈয়ের ঘটনা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করতে পারে। বাড়ৈ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন এবং ২০২০ সালের এপ্রিলে আমেরিকায় পালিয়ে যান। আরেকজন হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান। ব্লুমবার্গ বলছে, সাইফুজ্জামান আমেরিকায় বিনিয়োগ করেছেন।
সর্বশেষ, হাসিনার সহযোগীদের অর্থ পাচারের গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত সম্ভাব্য দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করতে হবে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাপারে আর্থিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বাড়াতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে এবং অর্থ পাচার ঠেকাতে আইনি সহায়তার জন্য সরকারগুলোর মধ্যে অংশীদারিত্বের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে অর্থ পাচারকারীদের জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে অংশীদারিত্বের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
একদিকে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে বিকল্প পথ খুঁজতে বাংলাদেশকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দ্রুত কাজ করতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্যের এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সরকারগুলোকেও পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশকে সহায়তা ও সহযোগিতার সদিচ্ছা দেখানো উচিত।
লেখক : নির্বাসিত একাডেমিক, কলামিস্ট, মানবাধিকার কর্মী এবং বিএনপির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।
মূল নিবন্ধটি ইংরেজিতে দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করে দেওয়া হলো।