চতুর্দিকে আওয়ামী লীগ ঠেকাও আওয়াজ চলছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ নৃশংস ও রক্তাক্ত শাসনামলের পর এমনতর 'ঠেকাও'র রণধ্বনি শোনা না গেলেই অবাক হতাম। কিছু ঠেকানো হচ্ছে তাৎক্ষণিক, আর কিছু দীর্ঘমেয়াদি।
আমরা কোন তরিকায় ঠেকাবো, সেটাও ভাবতে হবে খোলা মনে। তারও আগে ঠিক করতে হবে, আমরা কী কেবল আওয়ামীলীগকে ঠেকাবো? নাকি আওয়ামী-বয়ান বা চিন্তা/রাজনীতি পদ্ধতিতেই ঠেকাবো?
শুধু আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর কথা ভাবলে সেটা দিন শেষে 'নিষিদ্ধে'র রাজনীতির দিকে ধাবিত করবে সবাইকে। আওয়ামী লীগ থাকবে না, আসবে অন্যান্য নামের 'লীগ'। 'ক' এর স্থলে আসবে 'খ', 'গ' বা এমন কিছু। তবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে এটা কার্যকর হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ফল দিবে না।
অন্যদিকে, যদি আওয়ামী চিন্তা/রাজনীতি পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই, তাহলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি কার্যকলাপ। তার আগে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে, কীভাবে আওয়ামী এমন বয়ান তৈরি করতে সক্ষম হলো, যা মধ্যবিত্ত গিলে ফেললো? অথবা, বাংলাদেশের চিন্তার বাজারে জনপ্রিয় বয়ানগুলোকে কীভাবে আওয়ামী লীগ আত্মসাৎ করে ফ্যাসিবাদী হাতিয়ার বানিয়ে ফেললো?
গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিলেও কীভাবে তারা নিজেদের 'মন্দের ভালো' হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিল?
ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিমের চিন্তা এখনো প্রবলভাবে আওয়ামী-তাড়িত। এটা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনে হয়েছে। প্রচুর প্রাতিষ্ঠানিক জোগান আছে তাতে। প্রচুর লোকের মেহনত আছে। এমন বহুলোক আছেন, যাদের আওয়ামী লীগের সাথে ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু তাদের বক্তব্যকে আওয়ামী-বয়ান নিজের পেটে ঢুকিয়েছে। এই আত্মসাৎকরণ বুদ্ধিবৃত্তিক কসরতের মামলা। এই কসরত আওয়ামী লীগ করেছে, স্বীকার করতেই হবে।
এখন আপনি কী সেগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিবেন? নাকি মোকাবিলা করবেন?
আওয়ামী আমলে নিবর্তনমূলক আইনের কারণে এই মোকাবিলা করার প্রাতিষ্ঠানিক বাধা ছিল। এখন আপাতত সে বাধা নেই। আমরা আশা রাখি আইনগুলোর সংস্কার বা উবে যাবে।
এই মোকাবিলা কেবল এক দুই বছরের মামলা না। মধ্যবিত্তের যে বয়ানকে আওয়ামী নিজের বয়ান হিসাবে আত্মসাৎ করেছে, যাকে ধীরে ধীরে তার ফ্যাসিবাদের হাতিয়ারে পর্যবসিত করেছে, সেই 'বয়ান' এর উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, আত্মসাৎকরণ প্রায় বিশ-তিরিশ বছরে ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ যে 'বিভাজিত' রাজনীতি কায়েম করেছিল, সেটার 'রসদ' ছিল আমাদের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে।
আজকে যখন আমরা 'অন্তর্ভুক্তিমূলক' রাজনীতির কথা বলছি, সেটাও একদিনে হবে না। সেটার জন্য একইভাবে দীর্ঘমেয়াদি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মনে রাইখেন, 'প্রোপাগান্ডা'কে আমি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড বলছি না।
ধরেন, বিএনপি শাসনামলে কী কী হয়েছে, কোন সংখ্যালঘুর বাড়িতে হামলা হয়েছে, কোন সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে, তার সবকিছুর আর্কাইভ সরাসরি-আওয়ামী লীগ-না কিন্তু 'বৃহত্তর-অর্থে-আওয়ামী লীগ' এমন অনেক প্রতিষ্ঠান করে রেখেছে। কিন্তু আওয়ামী আমলে যে এতো লুট, খুন, গুম, ইত্যাদি হয়েছে, তার আর্কাইভ কয়টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো করেছে?
কিছু কিছু এনজিও করেছে, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত বাম-মধ্য-ডান কোনো মহলেই এমন বিপুল তৎপরতা দেখিনি। বিএনপি শেষের দিকে কিছু সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট/প্রতিবেদন করেছে, কিন্তু এগুলো খুব খুব ছোট আয়োজন।
ফলে, দেখবেন, বহু স্থানে এখনো অভ্যুত্থানকারী শক্তি হিসেবে আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা আওয়ামীলীগকে সরালেও আমাদের ইতিহাস বিষয়ক ভাবনা, চিন্তা ও রাজনীতি দুটোই আওয়ামী-বলয়েই আছে। এইজন্য আগেই আমরা বলতাম, 'শেখ হাসিনা কবে যাবি' তাৎক্ষণিক কার্যকর হলেও, দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর না। মানে, কেবল শেখ হাসিনার বিদায় ফরজ কাজ ছিল, কিন্তু এটাই একমাত্র ছিল না।
আওয়ামী চিন্তা/রাজনীতিকে পরাস্ত করতে চাইলে, দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রচুর গবেষণা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। কেউ যদি মনে করেন, একদিনে বা এক/দুই/পাঁচ বছরে সফল হয়ে যাবেন, তাহলে ভুল করবেন।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের যে হাল করে রেখে গিয়েছে, তা থেকে উত্তরণে এখনো দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। প্রত্যক্ষ পক্ষকেই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সমাজে প্রচুর স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের জরুরত রয়েছে। দল, সরকার, রাষ্ট্র - একাকার করে ফেললে কী হয়, তার নমুনা যেমন আওয়ামী লীগ আমলে দেখেছি, হাসিনার পতনের পর দেশের ভঙ্গুর হালত দেখেও বুঝতেছি।